ব্যাংক থেকে এমডিরা পালান কেন!
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচলক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন। প্রবাসী ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে এ ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলো। প্রথম থেকে শুরু করে বেশ কিছুদিন তার কোনো সমস্যা ছিলো না। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এ ব্যাংকেও দানব হানা দিয়েছে বলে বলা হচ্ছে। নানা ধরনের অনিয়ম ও বেনামি ঋণের চাপে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেয়াদ শেষের আগেই পদত্যাগ করেছেন। পত্রিকাগুলোকে তিন খুব সংক্ষেপে একটি কথা বলেছেন যে, ‘আামি ব্যাংকে অস্বস্তি বোধ করছিলাম, তাই পদত্যাগ করেছি’। অর্থাৎ একটি খারাপ পরিস্থিতি ব্যাংকের ভেতরে তৈরি হয়েছে, যার জন্যে তিনি চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। সেটি কারা করেছে? অবশ্যই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।
ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংক পরিচালনা করবেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বোর্ড সভা ছাড়া পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের ব্যাংকে আসার কথা নয়। তারা থাকবেন দূর নক্ষত্রের মতো। অথচ তারা এখন ব্যাংকগুলোকে দখল করে বসেছেন। যার ফলে এমডিরা কোনো কাজ করতে পারছেন না। বাংলদেশ ব্যাংক চাইলে একটি আইন করতে পারে যে, ব্যাংকের মালিকরাই ব্যাংক চালাবেন। কয়েকজন পরিচালকের চাপে ব্যাংকটিতে গত কয়েকমাসে বেশকিছু ঋণ অনুমোদন হয়, যা নিয়মিতভাবে আদায় হচ্ছে না। সম্প্রতি আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে টাকা দেওয়ার জন্যে চাপ দেওয়া হয় যার বেশিরভাই বেনামি ঋণ। যার জন্য এমডি পদত্যাগ করেছে। গত বছর ৪ টি ব্যাংকের এমডি পদত্যাগ করেছিলো। তাদের মধ্যে উদ্যোগী হয়ে ৩ জনকে ব্যাংকে ফেরাতে পেরেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, কিন্তু ১ জন আসেননি। আমরা একটি পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারি, এনআরবি ব্যাংকের নথিপত্র অনুযায়ী গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর একটি হাসপাতালের নামে ৫৫ কোটি টাকা চলতি মুলধন ঋণের অনুমোদন হয়। হাসপাতালটি একটি ভাড়া ভবন থেকে পরিচালিত হয়। ঋণের বিপরীতে তাদের তেমন কোনো জামানত নেই। ঋণ আদায় ইতোমধ্যেই অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। একইভাবে গত বছরের আগস্টে নতুন নিবন্ধিত হওয়া বরুন কর্পোরেশনকে ১৯ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়, যা নিয়মিতভাবে ফেরত পাচ্ছে না ব্যাংকটি।
গত আগস্টে ‘বেলা এগ্রো’ নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয় ৪ কোটি টাকা, যা ইতোমধ্যে অনাদায়ী হয়ে গেছে। তাহলে আপনারা হয়তো বুঝতেই পারছেন যে পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গেলে একজন এমডির পক্ষে দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হয়। কারণ তিনি জানেন যে, এই ঋণগুলো একটা সময় গিয়ে আদায় হবে না, যার সমস্ত দায় এসে উনার ঘাড়ে পড়বে। যেমন ভাবে অনেক ব্যাংকের নিরীহ ব্যাংকাররা এই অবস্থায় পড়েন। বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে যে নৈরাজ্য চলছে তা নতুন কিছু নয়। এসব সবাই জানে। ব্যাংক সম্পর্কে যারা জানে না তারাও জানে যে ব্যাংক খাতে একধরনের লুটপাট চলছে। জনগণের টাকায় যারা ব্যাংক পরিচালনা করে সেগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বদলে পুরোপুরিভাবে মালিকদের হাতে চলে গেছে। মালিকদের একটি একচেটিয়াত্ব চলছে ব্যাংকগুলোতে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্ত অবস্থান নিতে পারে না। কারণ আইন করেই সবকিছু করা হচ্ছে। এদের কারণেই হলমার্ক কেলেঙ্কারি হয়েছে। বেসিক ব্যাংক শেষ হয়ে গেছে শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুর কারণে। ফার্মার্স ব্যাংক উধাও হয়ে পদ্মা ব্যাংক হয়েছে। পিকে হালদার সৃষ্টি হয়েছে, বাচ্চু সৃষ্টি হয়েছে। সুনামে থাকা ইসলামী ব্যাংক এখন ধুকছে। আমরা জানি যে সকল ব্যাংকের অভিভাবক বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ আছে। সেটির মাধ্যমে প্রশাসন এবং রাজনৈতিক কর্তৃত্ব সরকার প্রয়োগ করতে পারে। ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের সচিব অনকে বড় ব্যক্তি হয়ে উঠছে।
এই দ্বৈত শাসন ব্যবস্থায় আসলে কোনো ব্যাংকের উপর থাকছে না। পুরো নিয়ন্ত্রণ নিতে গেলে বাংলাদেশে ব্যাংককে আর্থিক বিভাগের খপ্পর থেকে বের হতে হবে। এখন আইন আবার বদল করে পরিচালকদের স্থায়ী সম্মানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে ‘পরিচালকদের সভায় অংশগ্রহণের সম্মানি বাড়বে’। আমরা একটি কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছি। ব্যাংকের মালিকরা যদি নিজেরাই নিজেদের ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে ফেলেন তাহলে ব্যাংক চলবে কী করে? বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতের এমন দুর্বল অবস্থা কখনো ছিলো না। এখন কেন এমন হলো? এই কাজটি যখন থেকে শুরু হয়েছে সরকার যদি তখন থেকেই সচেতন হতো তাহলে হয়তো বর্তমান পরিস্থিতি এমন হতো না। আমাদের কাছে মনে হচ্ছে ব্যাংকিং খাতে আর সুশাসন আসবে না। পরিচিতি: সিনিয়র সাংবাদিক।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ফেসবুক পেজের ভিডিও কনটেন্ট থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন সঞ্জয় চন্দ্র দাস