নারী কেন স্তন দেখায় কিংবা ঢেকে রাখে আপাদমস্তক?
আহসান হাবিব
[১] নারী কেন স্তন দেখায় কিংবা ঢেকে রাখে আপাদমস্তক? প্রশ্নটা আমার প্রিয় কমরেডকে করতেই উত্তর দিলেন, পণ্য বোঝেন, স্তন বোঝেন না, কমরেড! আমি নীরব হই। এরপর থেকে আমি আর কোনো নারীর স্তন দেখি না, পণ্য দেখি। আর যারা ঢেকে রাখে জোর করে কিংবা কারো রক্তচক্ষুর ভয়ে, সেখানেও অবগুণ্ঠিত স্তন দেখি না, দেখি পণ্য। দুটোই প্রদর্শনের প্রান্তদশা, বিজ্ঞাপনের ছল।
[২] শরীর কখন পণ্য হলো? যখন সে ভূমিদাসত্ব থেকে মুক্ত হলো। এই মুক্তির বাণী পৃথিবীর মানুষ প্রথম শুনেছিল ফরাসি বিপ্লবে। মূল বাণী ছিল: স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী। এই তিনটি বাণীর মূল কথা মানুষের ভূমি দাসত্ব এবং ধর্মের নিগড় থেকে মুক্তি। কারা এই বাণী দিয়েছিল। সেই সময়ের উঠতি বুর্জোয়ারা। বিপ্লবোত্তর কি হয়েছিল? মানুষের ভূমি দাসত্ব থেকে মুক্তি মিলেছিল, কিন্তু পরক্ষণেই আরো বড় দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী হয়ে পড়েছিল। এর নাম মজুরি দাসত্ব। আর নতুন রাজার নাম পুঁজি। এই পুঁজির কাছে প্রথম বিক্রি হলো শ্রমশক্তি। ভূমি দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া মানুষ এই নতুন পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হলো তবে স্বাধীনভাবে। সে এখন যে কারো কাছে বিক্রি করতে পারে তার নিজের শ্রমশক্তি, এই বিরাট স্বাধীনতা সে লাভ করলো। এটাই বাণীর প্রথম কথা। সাম্য এবং মৈত্রী নামের অপর দুই বাণী প্রহসন হয়ে দেখা দিল এবং তা হয়েই আছে। সাম্য এই অর্থে যে পুঁজি সব মানুষকে সমান চোখে দেখতে বাধ্য করলো কিন্তু এর মালিকানার ক্ষেত্রে দেখা দিলো চরম বৈষম্য। মৈত্রী এক বিশাল কূটাভাস, অমিমাংসিত দ্বন্দ্বের রাষ্ট্রীয় রূপক। সেই থেকে পৃথিবীর সবকিছুই পণ্য হতে শুরু করলো।
[৩] ক্রমে যৌন সামগ্রী হয়ে উঠলো এক একটা পণ্য। পুরুষ এবং নারীর উভয়ের শরীর এই পণ্যের কাঁচামাল। কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে নারী ও পুরুষের শরীরের শ্রমশক্তিটাই পুঁজিপতিদের কাছে প্রথম প্রায়োরিটি হলেও নারী শরীরের যৌন অঙ্গগুলো হয়ে উঠলো বিশেষ পণ্য। এগুলো সরাসরি পণ্য উৎপাদন করে না, দেয় যৌন তৃপ্তি। এর মূল্য চড়া। এদিকে নারী যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের নিগড়ে বন্দী, তাই তাদের শরীরের যৌনাঙ্গগুলো হয়ে উঠলো এক একটা হাতিয়ার- অস্তিত্ব এবং নিরাপত্তার। শ্রমশক্তি তো আছেই, প্রতিদিনই কোটি কোটি নারী বিক্রি করছে। ওখানে যৌনতা নেই, কেবল শ্রমশক্তি। পুরুষ যে নারীর উপর এই আধিপত্য প্রয়োগ করে, তার মূল শক্তি হলো ব্যক্তিগত সম্পদ। পুঁজিবাদ এই অধিকার তাকে দিয়ে বসে আছে। আর প্রকৃতি এবং সামাজিক বিকাশের বলি নারী হয়ে পড়েছে পুঁজি এবং পুরুষের অধীন। এই অধীনতা থেকে মুক্তির সংগ্রাম চলছে। ব্যক্তিগত সম্পদের বিলোপ তথা পুঁজিবাদের বিলোপই এর সমাধান।
[৪] কিন্তু নারী তার যৌন সামগ্রী দেখায় কেন? যৌন বিজ্ঞানের ভাষায় নারীকে ডাকা হয়, ঊীযরনরঃরড়হরংঃ অর্থাৎ প্রদর্শনকারিণী এবং পুরুষদের বলা হয় ঠড়ুবঁৎরংঃরপ অর্থাৎ যারা দেখে এবং এই দেখায় যৌন আনন্দ পায়। এই আনন্দ পাওয়া নারীদের একটি হাতিয়ার হয়ে উঠলো। বিবর্তন তাকে গড়েছে তার উদ্দেশ্য সফলের স্বার্থে অর্থাৎ তার প্রজাতি টিকিয়ে রাখার জন্য কিন্তু মানুষÑ এক চরম বুদ্ধিমান প্রাণি, তাকে ব্যবহার করেছে যৌনতৃপ্তি উপভোগের লক্ষ্যে। প্রকৃতি এবং সামাজিক বিকাশের বিরূপতায় নারী বাধ্য হয় তার শরীরকে বিশেষত তার যৌনাঙ্গগুলোকে পণ্য হিসেবে প্রদর্শন করতে। পুঁজিবাদের এতে অনেক লাভ। তার দরকার শ্রমিক, এই শ্রমিক যদি হৃষ্টপুষ্ট, তাহলে তার শণৈ শণৈ লাভ। আর প্রজাতি রক্ষা এবং সম্পদের উত্তরাধিকার সৃষ্টিতে এমন প্রোডাক্ট চাই পুরুষের যা তার ভবিষ্যৎকে সুরক্ষা দেবে। এই সুরক্ষার যোগানদাতা নারীর সুন্দর দেহসৌষ্ঠব এবং শক্তিশালী। এই দুই চাহিদা মেটাতে নারী নিজেদের শরীর দেখাতে প্রথমে বাধ্য এবং শেষে অভ্যস্ত হয়ে উঠলো। এইই তাদের অস্তিত্বের এক রকম রক্ষাকবচ হয়ে উঠলো। আর পুঁজিবাদ এটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে পণ্যায়িত করে চললো। তার লাভে লাভ। যে মানুষ এই পণ্য কেনে, তাতে থাকে তার উদ্বৃত্তমূল্য আবার যে অর্থ সে তার শ্রম বেঁচে পায়, সেখানেও থাকে কম মজুরি।
[৪] এই প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা কবে বন্ধ হবে? আগেই বলেছি ব্যক্তিগত সম্পদ আহরণের পথ যেদিন বিলুপ্ত হবে সেদিন। সে এক কঠিন লড়াই। মুক্তিকামী মানুষ সে লড়াই লড়ে চলেছে এবং পৃথিবী একদিন সুষম হয়ে উঠবে। লেখক: ঔপন্যাসিক