ক্ষুদ্রঋণ বিতর্ক : ক্ষুদ্রঋণের সুবিধা-অসুবিধা ও চ্যালেঞ্জ
[১] ড. খলীকুজ্জামান আহমদ, অর্থনীতিবিদ ও চেয়ারম্যান, ঢাকা স্কুল অব ইকোনোমিকস: রবীন্দ্রনাথ অনেক আগেই ক্ষুদ্রঋণের প্রচেষ্টা করেছেন। তার সময়ে এটি কাবুলিওয়ালারাও করতো। কিন্তু তাদের মধ্যে একটু ভেদাভেদ আছে। রবীন্দ্রনাথ আদায়ে বেশি জোর দিতে পারেননি বলে খুব বেশিদিন চলেনি। কাবুলিওয়ালারা আদায় করতে পারতেন বলে সেটি চলেছে। বাংলাদেশে প্রথম ব্র্যাক এটি শুরু করে ১৯৭৪ সালে। তারপর অনেক এনজিও এটি নিয়ে কাজ করেছে ও আস্তে আস্তে সম্প্রসারিত হয়েছে। এই ঋণের ক্ষেত্রে পরিমাণ যখন একটু বড় হয়ে যায় তখন কোনো ধরনের নীতি কাজ করে না। এটির মূলের মধ্যেই আছে ছোট রাখা। কাজেই যখন এটি ছোট থাকবে তখন এটি কাজ করবে। এটিকে যেভাবে ব্যস্থাপনা করা হয়েছে সেখানে দেখা যাচ্ছে যে এটি একটি জামানত। টাকার পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে এই জামানত আর কাজ করে না। প্রথমেই ৫ শতাংশ কেটে রাখা হতো বাধ্যতামূলক সঞ্চয় হিসেবে। সেখানে যে ইন্টারেস্ট রেট দেওয়া হতো তা মার্কেটের ইন্টারেস্ট রেট থেকে অনেক কম। ৯০ এর দশকে এসে এটি একটি ব্যবসার আকার ধারণ করলো এবং চললো ২০০৯-২০১০ পর্যন্ত। এটিকে ‘লোন শার্ক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হলো। গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হারটি অন্যান্য এনজিও থেকে কম ছিলো সবসময়। অন্যান্য জায়গায় ২০০৯ সালে হিসাব করা হয়েছিলো যে সুদের হার ৩৫-৫০ শতাংশে চলে গিয়েছিলো। এর মানে হলো সুদের হার যাদি এতো হয় তাহলে তাদের আয় কতো বা তারা কতো টাকার ফান্ড গঠন করে?
[২] অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়: স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু সমাজসেবা অধিদপ্তরে সুদমুক্ত ঋণ শুরু করেন। সেই কনসেপ্ট ধরেই এখন সমাজসেবা মন্ত্রণালয় কাজ করছে। এসব ঋণের ক্ষেত্রে নারীদের টার্গেট করার পেছনে কারণ হলো, যখন প্রফেসর ইউনূস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছিলেন তখন তিনি পুরুষদের ক্ষুদ্রঋন দিতেন এবং সেই টাকা নিয়ে অনেকে পালিয়ে গেলো না ফেরত দিয়েই। পরবর্তী সময়ে তার রিয়েলাইজেশন হলো যে যদি নারীদের ঋণ দেওয়া হয় তাহলে তারা পালিয়ে যাওয়ার মতো কাজ করবে না। তাছাড়া দেখা গেলো যে নারীরা এই ক্ষুদ্র ঋণকে বিভিন্ন আত্মউন্নয়নমূলক কাজে লাগায়। এরপর থেকেই উনি নারীদের ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিলেন। ডেভলপমেন্টে যখন আমরা নারীদের অংশগ্রহন দেখি তখন আমরা বলি যে নারীদের টার্গেট করা সহজ। আমার কাছে মনে হয় ক্ষুদ্র ঋণ খুবই একটি কমপ্লেক্স বিষয়। ইন্টারেস্ট বিষয়টি ডিপেন্ড করে পুরো ব্যবস্থাপনার উপর। ক্ষুদ্র ঋণের একটি অবজেক্টিভ সাইট আছে এবং সাবজেক্টিভ সাইট আছে। যারা ঋণ দিচ্ছে তারা অনেকসময় হিডেন রাখে অনেক কিছু।
[৩] ফারুক ফয়সাল, নির্বাহী পরিচালক আইন ও সালিশ কেন্দ্র: ১৯৮৭ সালে যখন আমি প্রথম আমেরিকাতে যাই, সেই সময়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টের যিনি সাউথ এশিয়া দেখতেন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ড. ইউনূসের মতো কাউকে যদি শাসন ভার দেওয়া হয় তাহলে কেমন হয়? এরপর তিনি বললেন যে, ইউনূসের কার্যকলাপ যুগান্তকারী ভূমিকা সৃষ্টি করেছে। একটি জিনিস স্বীকার করতে হবে যে ক্ষুদ্র ঋণ বাংলাদেশকে বিশেষভাবে বিশ্বের কাছে পরিচিত করেছে। ড. ইউনূসের একসময় রাজনৈতিক অভিলাস ছিলো বলে আমার ধারণা। আমি বলি, ড. ইউনূস বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি করেনি বরং উপকার করেছে। আমাদের এই সম্মানটি তাকে দিতেই হবে। নোবেল পুরস্কার কিন্তু ড. ইউনূস একা পাননি, ব্যাংকসহ পেয়েছে। এক্ষেত্রে উনাকেই সব দায়-দায়িত্ব নিয়ে করতে হবে তা নয়। যখন জোব্রা গ্রামে প্রথম এক্সপেরিমেন্ট হয় ক্ষুদ্র ঋণ, তখন কিন্তু জেন্ডার ইকুয়্যালিটি ছিলো না। যখন জেন্ডার ইকুয়্যালিটি চেঞ্জ এসেছে তখন তিনি তার পদ্ধতি পরিবর্তন করেছে।
[৪] ড. আহসান এইচ মনসুর, অর্থনীতিবিদ ও নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউট: আমরা মাইক্রো ক্রেডিটের সাথে বাংলাদেশের পলিটিক্স এক করে ফেলছি। যে জিনিসটি আমাদের ফরমাল সেক্টর দিতে পারেনি সেটি থেকে কীভাবে মানুষকে বের করে আনা যায়। তখনকার দিনে আমাদের ব্যাংকাররা গ্রামে যেতেন না। আমি যদি টাকা দিয়ে টাকা ফেরত না নিতে পারি, তাহলে সেটি দান হিসেবে দিয়ে চলে আসতে হবে। বিজনেস মডেল দাড় করাতে হলে আমাকে ফান্ড দিয়ে আবার সেটিকে আদায় করে আনতে হবে। আদায় না করতে পারলে সেই মডেলকে সাকসেস মডেল হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। কাজেই আমাকে বুঝতে হবে যে আদায় করাটা কোনো অপরাধের মধ্যে পরে না। আমি সাধারণ অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি যে আমাকে টেকনিক্যালি প্রেসার রাখতে হবে যেন টাকা ফেরত আনা যায়। তা না হলে টাকা আনার কোনো উপায় থাকবে না। আমাদের যদি সামাজিক বিবর্তনের কথা চিন্তা করা হয়, তাহলে নারীদের কেউ ঋণ দিবে এটি চিন্তাও করতে পারতো না আমাদের মায়েদের আমলের মানুষেরা। নারীদের যেকোনো অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকতে পারে এরকম কোনো চিন্তা ভুলেও তারা করতে পারতো না। বাংলাদেশে এখনো ফরমাল ব্যাংকিং খাতে আমি দেখেছি উইমেন পার্টিসিপেশন নট ইভেন ১ পার্সেন্ট। ব্র্যাক ব্যাংকে এসএমই খাতে লোন ছিলো ৫৪ শতাংশ তাদের মধ্যে নারীদের সদস্যে ৪-৬শতাংশ। এই জায়গাগুলোতে আমাদের নজর দিতে হবে। এটিকে সফট টার্গেট বললে হবে না।
[৫] ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন, আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট: ড. ইউনূসকে ১৯৮৭ থেকে পশ্চিমারা টার্গেট করেছে আমি এই বক্তব্যের সাথে একমত নই। বঙ্গবন্ধু তার সারা জীবনের সমস্ত কিছু দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনলেন। যেকোনো কারণেই হোক স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে তিনি বাংলাদেশ সাজিয়ে যেতে পারেননি। বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো সবচেয়ে দরিদ্রতম দেশের কাতারে। আমি কিন্তু ড. ইউনূসের সাথে পূর্বে জড়িত ছিলাম না। আমি তার আইনি জটিলতার মাধ্যমে জড়িত হয়েছি। এর মাধ্যমে যতটুকু আমি দেখেছি এক সেকেন্ড সময়ও তিনি আলোচনার মাধ্যমে ব্যয় করেন না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন লোক আমি আর দেখিনি। সবার সাথেই সময় ধরে আলোচনা করেন। ক্ষুদ্র ঋণের বিতর্কে আমিও ছিলাম। কিন্তু আমি দেখলাম যে গরিব মানুষের কাছে টাকা যখন আসে তখন তা সাথে সাথে রিকোভারি না করলে খরচ হয়ে যাবে। তিনি যখন বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে মেয়েদের লোন দেওয়ার কথা বললেন উনাকে পাগল বলে আখ্যায়িত করা হলো। কিন্তু এই পাগল প্রমাণ করলো ব্যাংকের লোন ৯৭ শতাংশ লোন রিকোভারি হয়েছে এই দরিদ্র নারীদের কাছ থেকে। মাকে যদি উন্নয়ন করা যায় তাহলে ছেলে-মেয়ের উন্নয়ন হবেÑ এটি হলো তার কনসেপ্ট। এই কনসেপ্টের কাজ করেই উনি নোবেল পেয়েছেন।
[৬] অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান, জেষ্ঠ আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট: ড. ইউনূসের বিষয় নিয়ে একদল প্রধানমন্ত্রীকে টার্গেট করছে। এর মানে এই যে তারা বিচার বিভাগকে বিশ্বাস করে না। তারা ভাবছে যে প্রধানমন্ত্রী সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। এর মাধ্যমে আসলে উনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এই বিচার ব্যবস্থার কোনো সম্পর্কই নেই। বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন।
সূত্র: একাত্তর টিভি। ‘এডিটরস গিল্ড’ অনুষ্ঠানের ভিডিও কনটেন্ট থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন সঞ্জয় চন্দ্র দাস