বাংলাদেশ কীভাবে ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করে?
প্রান্ত চ্যাটার্জি : বাংলাদেশ দুটি এশিয়ান জায়ান্ট চীন ও ভারতের মধ্যে একটি কৌশলগত অঞ্চলে অবস্থিত। উভয় দেশই বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের প্রভাব, সহযোগিতা সম্প্রসারণে আগ্রহ দেখিয়েছে, অর্থনৈতিক সুযোগ ও চ্যালেঞ্জের প্রস্তাব দিয়েছে। এই দুই শক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ভারসাম্য কীভাবে বজায় রাখা উচিত এই প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কী ভূমিকা পালন করেন? শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয় নেতাদের একজন। তিনি ২০০৯ সাল থেকে টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছেন, দেশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের দিকে নিয়ে গেছেন। জলবায়ু পরিবর্তন, নারীর ক্ষমতায়ন, আঞ্চলিক সহযোগিতার মতো বিষয়ে তার দূরদর্শী নেতৃত্ব ও উদ্যোগের জন্যও তিনি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছেন। শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম প্রধান দিক হলো চীন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক পরিচালনার ক্ষেত্রে তার বাস্তববাদী ও কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার পাশাপাশি উভয় দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের নীতি অনুসরণ করেছেন। তিনি ভারত, বাংলাদেশের ঐতিহাসিক মিত্র, প্রতিবেশী চীন, বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার ও বিনিয়োগকারীর সঙ্গে গঠনমূলকভাবে জড়িত থাকার সঙ্গে সঙ্গে একটি ঘনিষ্ঠ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন।
বাংলাদেশ-ভারত তাদের অভিন্ন ইতিহাস, সংস্কৃতি, মূল্যবোধের মধ্যে নিহিত একটি দীর্ঘ ও গভীর বন্ধন ভাগ করে নেয়। ভারতই প্রথম দেশ যারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয় ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তার মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিলো। তারপর থেকে দুই দেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে, যেমন বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, জ্বালানি, সংযোগ ও উন্নয়ন সহায়তা। ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। ২০১৯-২০ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ইউএসডি ১০.২৫ বিলিয়নে পৌঁছেছে। ভারতও বাংলাদেশের বৃহত্তম উন্নয়ন অংশীদার, অবকাঠামো প্রকল্পগুলির জন্য ইউএসডি ১০ বিলিয়ন মূল্যের ক্রেডিট লাইন সহ ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে বেশ কয়েকটি অসামান্য সমস্যার সমাধান করেছে। যেমন স্থল ও সামুদ্রিক সীমানা, গঙ্গার পানির বণ্টন-ছিটমহল বিনিময় ভারতও ট্রানজিট-পরিবহন চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব রাজ্য ও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ যেমন নেপাল, ভুটানে প্রবেশের সুবিধা দিয়েছে।
বাংলাদেশ-চীন পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সুবিধার ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী ও ব্যাপক অংশীদারিত্ব গড়ে তুলেছে। চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার, ২০১৯-২০ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ইউএসডি ১৮.২৪ বিলিয়নে পৌঁছেছে। চীনও বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিদেশি বিনিয়োগের উৎস। যেখানে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ইউএসডি ৩.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। চীন বাংলাদেশের সামরিক হার্ডওয়্যারের বৃহত্তম সরবরাহকারীও। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অস্ত্র আমদানির ৭১.৮ শতাংশের জন্য দায়ী। চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, ২০১৩ সালে চীন কর্তৃক চালু করা একটি বৈশ্বিক অবকাঠামো ও সংযোগ প্রকল্পে বাংলাদেশের অংশগ্রহণকে সমর্থন করেছে। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর বাংলাদেশ সফরের সময়, দুই দেশ ৩৮.০৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ২৭টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। যার মধ্যে বিদ্যুৎ, পরিবহন, যোগাযোগ ও শিল্প পার্কের মতো খাত রয়েছে। চীন বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারও দিয়েছে, যা ১ জুলাই, ২০২০ থেকে কার্যকর হবে।
তবে চীন-ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকিমুক্ত নয়। চীন, ভারত এই অঞ্চলে ও তার বাইরেও প্রভাব বিস্তারের জন্য কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। দুটি দেশ তাদের বিতর্কিত সীমান্ত, ভারত মহাসাগরে তাদের ভূমিকা, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারের মতো অন্যান্য দেশে তাদের জড়িত থাকার বিষয়ে সংঘর্ষ করেছে। বাংলাদেশকে এই দুই শক্তির মধ্যে সাবধানে চলাচল করতে হবে। পক্ষ নেওয়া বা তাদের দ্বন্দ্বে টানা এড়িয়ে চলতে হবে। বাংলাদেশকে নিশ্চিত করতে হবে যে চীনের সঙ্গে তার অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা তার সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা বা ঋণের স্থায়িত্বের সঙ্গে আপস না করে। বাংলাদেশকে চীনের ঋণ-ফাঁদ কূটনীতি থেকে সতর্ক থাকতে হবে। যা শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, পাকিস্তানের মতো বেশ কয়েকটি দেশকে টেকসই ঋণ ও কৌশলগত সম্পদের ক্ষতির মধ্যে আটকে রেখেছে। বাংলাদেশকে ভারতের সঙ্গে তার নিরাপত্তা সহযোগিতার সঙ্গে চীনের সঙ্গে তার সামরিক সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। যেটি বাংলাদেশকে তার প্রতিবেশী প্রথম নীতি, একটি মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিকের দৃষ্টিভঙ্গির মূল অংশীদার হিসাবে বিবেচনা করে।
তাই পরিবর্তনশীল ও চ্যালেঞ্জিং বিশ্বে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা, সমৃদ্ধি বজায় রাখতে শেখ হাসিনা ও ভারতের আরও বেশি একাত্বতা প্রয়োজন। চীন, ভারতের পাশাপাশি অন্যান্য দেশ ও সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক পরিচালনায় শেখ হাসিনা তার প্রজ্ঞা ও দক্ষতা দেখিয়েছেন। তিনি একটি ভারসাম্যপূর্ণ, বৈচিত্র্যময় বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করেছেন। ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব ও কারও সঙ্গে বিদ্বেষ নয়’, নীতি অবলম্বন করেছেন। তিনি অংশীদারদের সংবেদনশীলতা, উদ্বেগকে সম্মান করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ ও আকাক্সক্ষাকেও অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তিনি তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধু ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার করেছেন। পাশাপাশি চীনের সঙ্গে তার সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে প্রভাবশালী অংশীদারের সহযোগিতা প্রসারিত করেছেন। তিনি একজন দায়িত্বশীল ও গঠনমূলক অভিনেতা হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি, ভূমিকাকেও উন্নীত করেছেন।
বাংলাদেশের আরও বেশি শেখ হাসিনা ও ভারত প্রয়োজন। কারণ তারাই এর শান্তি ও উন্নয়নের সেরা গ্যারান্টার। তারা একটি সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল দক্ষিণ এশিয়ার একটি অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ভাগ করে নেয়। যেখানে সমস্ত দেশ সম্প্রীতি ও সহযোগিতায় বসবাস করতে পারে। তারা গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদের প্রতি একটি সাধারণ অঙ্গীকারও ভাগ করে নেয়। যা বাংলাদেশের পরিচয় ও সংবিধানের মূল মূল্যবোধ। তারা একটি সাধারণ ভাগ্য ভাগ করে নেয়। কারণ তারা ২১ শতকে একই ধরনের চ্যালেঞ্জ ও সুযোগের মুখোমুখি হয়। শেখ হাসিনা ও ভারতকে বাংলাদেশের আরও বেশি প্রয়োজন, কারণ তারাই বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু ও অংশীদার।
লেখক : সাবেক আইসিসিআর স্কলার, কলামিস্ট ও গবেষক। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : ডেইলি অবজার্ভার