স্বর্ণ-গহনা রপ্তানি : বাংলাদেশের উজ্জ্বল সম্ভাবনা
এম মুনির হোসেন : বাংলাদেশে সোনার মোহন নিছক নান্দনিকতা অতিক্রম করে। এটি গভীরভাবে সাংস্কৃতিক ফ্যাব্রিকের মধ্যে এমবেড করা হয়েছে। যা সম”দ্ধি, ঐতিহ্য ও সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হিসেবে কাজ করছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাঙালি সংস্কৃতিতে সোনা একটি শ্রদ্ধেয় অব¯’ান ধরে রেখেছে। যা ঐতিহ্য, বিবাহ, উৎসব ও আচার-অনুষ্ঠানে জটিলভাবে বোনা হয়েছে। এটি কেবল সম্পদেরই নয়, বিশুদ্ধতা, পারিবারিক ঐতিহ্যেরও প্রতীক, যা মানুষের জীবন ও পরিচয়ের একটি অবি”েছদ্য অংশ গঠন করে। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশ গত এক দশকে প্রায় ১৫ টন গড় বার্ষিক চাহিদা সহ সোনার গহনা ব্যবহারের একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করে। এই সামঞ্জস্যপূর্ণ চাহিদা বাংলাদেশকে দণি এশিয়ায় সোনার গহনার শীর্ষ ভোক্তাদের মধ্যে ¯’ান দেয়। সাংস্কৃতিক প্রাধান্য থাকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশের জুয়েলারি খাত ঐতিহাসিকভাবে অনানুষ্ঠানিক বলে বিবেচিত হতো। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) এর সক্রিয় নেতৃত্ব গত কয়েক বছরে প্রায় ৪০,০০০ জুয়েলারি ব্যবসায়ীকে এর ছত্রছায়ায় একত্রিত করেছে। যা শিল্পের আনুষ্ঠানিকতা ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার দিকে একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। স্বর্ণ সেক্টরের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কল্পনা করে কেউ রিডজ-মেড গার্মেন্টস (আরএমজি) শিল্পের রূপান্তরমূলক যাত্রার সমান্তরাল আঁকতে পারে। যথাযথ নীতি সমর্থন ও কৌশলগত বিনিয়োগের মাধ্যমে স্বর্ণ শিল্পের আগামী বছরগুলোতে দেশের শীর্ষ¯’ানীয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী হিসাবে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। স্বর্ণ ও গহনার ক্রমাগত ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক চাহিদা বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে মূল খেলোয়াড় হিসাবে অব¯’ান করার জন্য একটি প্রতিশ্রুতিশীল সুযোগ উপ¯’াপন করে।
বৈশ্বিক মঞ্চে বিশেষ করে এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে উদীয়মান বাজারগুলোর ক্রমবর্ধমান সম”দ্ধির দ্বারা চালিত সোনার গহনার চাহিদা ক্রমাগত ব”দ্ধি পা”েছ। বাজারের আকার ২০২৪ সালে ৪.৪২ কিলো টন থেকে ২০২৯ সালের মধ্যে ৬.৩২ কিলো টনে উন্নীত হওয়ার অনুমান করা হয়েছে। যার একটি চক্রব”দ্ধি বার্ষিক ব”দ্ধির হার ৭.৩৮ শতাংশ। বৈশ্বিক জুয়েলারি বাজার ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হ”েছ। যা বাংলাদেশকে প্রব”দ্ধি ও সম্প্রসারণের উল্লেখযোগ্য সুযোগের সঙ্গে উপ¯’াপন করবে। বসুন্ধরা গ্রুপের দ্বারা দেশের প্রথম স্বর্ণ শোধনাগার প্রতিষ্ঠা এই যাত্রায় উল্লেখযোগ্য মাইলফলক ছুঁয়েছে। এটি শুধুমাত্র বিদেশি স্বর্ণ আমদানির উপর বাংলাদেশের নির্ভরতা কমায় না, বরং দেশটিকে বৈশ্বিক বাজারে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যের মতো অঞ্চলে যেখানে বর্তমানে ভারতের আধিপত্য রয়েছে সেখানে প্রতিযোগিতার জন্য অব¯’ান করে। যদিও আরএমজি খাত বাংলাদেশের রপ্তানি অর্থনীতির মূল ভিত্তি হিসাবে রয়ে গেছে। তাই স্বর্ণ, গহনা শিল্প মূল্য সংযোজন ও লাভের মার্জিনের েেত্র স্বতন্ত্র সুবিধা প্রদান করে। পোশাকের বিপরীতে, যা প্রায়শই তীব্র মূল্য প্রতিযোগিতা, গহনা পণ্যগুলো তাদের কারুকাজ, ডিজাইনের জটিলতা ও অনুভূত বিলাসিতাগুলোর কারণে উ”চ মূল্যের আদেশ দেয়। উদ্ভাবন, মান নিয়ন্ত্রণ, ব্র্যান্ডিং উদ্যোগের উপর দ”ষ্টি নিবদ্ধ করে, বাংলাদেশ একটি প্রিমিয়াম জুয়েলারি গন্তব্য হিসাবে নিজের জন্য একটি বিশেষ ¯’ান তৈরি করতে পারে, বিচণ ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে পারে ও বিশ্ব বাজারে প্রিমিয়ামের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
২০২২ সালের আর্থিক বছরে ৩৯ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি মূল্য সহ গহনা রপ্তানিতে ভারতের সাফল্যের গল্প, বাংলাদেশের স্বর্ণ শিল্পে রপ্তানি ব”দ্ধির সম্ভাবনার উপর জোর দেয়। থাইল্যান্ড, তুরস্ক ও ইতালির মতো অন্যান্য দেশগুলো বিশ্বব্যাপী গহনা বাজারে একটি প্রতিযোগিতামূলক প্রান্ত অর্জনের জন্য তাদের কারিগর দতার ব্যবহার করেছে। শিল্পকে বৈশ্বিক মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার জন্য টেকসই নীতি সমর্থন অপরিহার্য। রূপান্তরমূলক নীতিগুলোর সঙ্গে সাদ”শ্যপূর্ণ যা আরএমজি সেক্টরকে তার বর্তমান প্রাধান্যের সঙ্গে ক্যাপল্ট করেছে। জুয়েলারি শিল্পের জন্য উপযুক্ত নীতি কাঠামো প্রয়োজন যা এর অনন্য চ্যালেঞ্জ ও সুযোগগুলো মোকাবেলা করে। উ”চ আমদানি শুল্ক ও কর, নিয়ন্ত্রক সীমাবদ্ধতার সঙ্গে খাতগত ব”দ্ধিতে উল্লেখযোগ্য বাধা স”ষ্টি করে বলে শিল্পের অভ্যন্তরীণরা বলছেন। এই প্রতিবন্ধকতাগুলো হ”াস করার ল্েয নীতি সংস্কার একটি অনুকূল ব্যবসায়িক পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য অপরিহার্য। নিয়ন্ত্রক প্রক্রিয়াগুলোকে স্ট্রীমলাইন করা, ট্যারিফগুলোকে যুক্তিযুক্ত করা, উদ্ভাবন ও রপ্তানি প্রচারের জন্য প্রণোদনা প্রদান শিল্পের পূর্ণ সম্ভাবনা উন্মোচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদপে। অবকাঠামোগত ঘাটতি, অর্থের সীমিত অ্যাক্সেস শিল্পের সম্প্রসারণ ও উদ্ভাবনের মতাকে বাধাগ্রস্ত করে।
এই পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতাগুলো মোকাবেলা করার জন্য ল্যযুক্ত নীতি হস্তপে প্রয়োজন। অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ, যেমন বিশেষায়িত শিল্প জোন, জুয়েলারি কাস্টার প্রতিষ্ঠা, প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সহায়তা প্রদান করে ও শিল্প খেলোয়াড়দের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে ব”দ্ধিকে অনুঘটক করতে পারে। সাশ্রয়ী মূল্যের অর্থের অ্যাক্সেস সহজতর করা, বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি আকারের উদ্যোগের (এসএমই) জন্য সর্বোত্তম। নীতিগত উদ্যোগ যা সমান্তরাল প্রয়োজনীয়তা সহজ করে, সুদের হার কম করে, উপযুক্ত ক্রেডিট স্কিম প্রদান করে এসএমইকে প্রযুক্তি আপগ্রেডে বিনিয়োগ করতে, উৎপাদন মতা প্রসারিত করতে ও নতুন বাজার অন্বেষণ করতে সম করে। গহনা শিল্পের জন্য তৈরি দতা উন্নয়নের উদ্যোগগুলো প্রতিযোগিতা বাড়ানো ও উদ্ভাবন চালানোর জন্য অপরিহার্য। সরকার, শিল্প সমিতি ও শিাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা বিশেষ প্রশিণ কর্মসূচি তৈরি করতে সহায়তা করতে পারে। যা কারিগর, কারিগরদের প্রয়োজনীয় দতা ও জ্ঞান দিয়ে বাজারের বিকাশমান চাহিদা মেটাতে সজ্জিত করে। গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমকে উৎসাহিত করা শিল্পের ব”দ্ধির জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ডিজাইন, উপকরণ, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় উদ্ভাবনে উৎসাহিত করা বিশ্ব বাজারে পণ্যের পার্থক্য ও প্রতিযোগিতা বাড়াতে পারে। কর প্রণোদনা, গবেষণা ও উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য অনুদান, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব উদ্ভাবনে বিনিয়োগ উদ্দীপিত করতে পারে ও উ”চ মূল্য সংযোজন পণ্যের দিকে শিল্পের উত্তরণকে অনুঘটক করতে পারে। সংেেপ বলা যায়, বাংলাদেশের স্বর্ণ ও গহনা শিল্প আরএমজি শিল্পের আধিপত্যকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একটি শীর্ষ¯’ানীয় রপ্তানি খাত হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার অধিকারী। এর সম”দ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, দ কারুকাজ ও কৌশলগত ভৌগলিক অব¯’ানকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ সোনার গহনার ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক চাহিদা পুঁজি করতে পারে। এই দ”ষ্টিভঙ্গি উপলব্ধি করার জন্য মূল্য শ”ড়খল জুড়ে স্টেকহোল্ডারদের সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। মূল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে, উদ্ভাবনে উৎসাহিত করে ও অংশীদারিত্বের সুবিধার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার জুয়েলারিশিল্পের সুবর্ণ সম্ভাবনাকে আনলক করতে পারে, টেকসই অর্থনৈতিক প্রব”দ্ধি ও সম”দ্ধির পথ প্রশস্ত করতে পারে। লেখক : বার্তা সম্পাদক।
অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : ডেইল সান