মুক্ত হোক মায়ের ভাষা
অজয় দাশগুপ্ত
‘জননীর স্তনদুগ্ধ যদ্রুপ অন্য সকল দুগ্ধ অপেক্ষা বল বৃদ্ধি করে; তদ্রুপ জন্মভূমির ভাষা অন্য সকল ভাষা অপেক্ষা মনের বীর্য প্রকাশ করে।’Ñরাজনারায়ণ বসু। মাতৃভাষা হলো মানুষের আবেগ-অনুভূতির প্রকৃত প্রকাশ মাধ্যম। তার জিয়নকাঠির স্পর্শেই নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হয়, বোধের গভীরে চিন্তার বুদবুদ কারার দ্বার ভেঙে বাইরে এসে বাক?্মূর্তি ধারণ করে। আর অন্যদিকে শিক্ষা হলো মানবজীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। মানুষের সকল ধনসম্পত্তি মানুষকে ছেড়ে চলে গেলেও অর্জিত শিক্ষা ও জ্ঞান কখনো মানুষের সঙ্গ ছাড়ে না। তাই সেই অর্জিত শিক্ষার সঙ্গে মানুষের অন্তস্থলের আবেগের যোগ থাকা একান্ত আবশ্যক। সে কারণে শিক্ষার সঙ্গে মানুষের অন্তরের আবেগকে যুক্ত করার জন্য প্রয়োজন মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের। প্রাণের ভাষা ও প্রাণের জ্ঞান একত্রিত হলে তবেই একজন সার্থক মানুষরূপে পৃথিবীর বুকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা সম্ভব হবে।
একুশে আমাদের অহংকার। এটা সবাই জানি। আজ এতবছর পর একুশে ফেব্রুয়ারি কোথায় দাঁড়িয়ে? যে ভাষা আন্দোলন নিয়ে আমরা গর্ব করি সে ভাষার কি অবস্থা এখন? এসব বিষয় বিবেচনা না করলে আবেগের নদীতে ডুবে মরার বিকল্প থাকবে না। আমি মধ্য ষাট বয়সী। আমার জীবনে আমি ভাষার যে সম্মান আর গৌরব দেখেছি তার সাথা আজকের বাস্তবতা মিলিয়ে দেখলে হতাশ হই। মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করি, এ জন্যই কি আত্মহুতি দিয়েছিলেন ভাষা সৈনিকেরা? আজ অবধি আমাদের দেশের শিল্প, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও রাজনীতিতে একুশের মতো কোনো স্মরণীয় দিন নেই। মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা বিজয় দিবসের পাশাপাশি এই দিনটি আমাদের অহংকারের প্রতীক ।
বলছিলাম ভাষার গৌরবের কথা। মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্নে দেয়ালে দেয়ালে একটি পোস্টার চোখে পড়তো। যাতে লেখা থাকতো, একটি বাংলা বর্ণ একেকটি বাংলা অক্ষর একজন বাঙালির প্রাণ। আহা! কী আবেগ আর কী আকুতি। সে আবেগ আজ নিস্তব্দ। পথহারা বেগের কাছে আকুল ভাবে আত্মসমর্পিত । কেন এই দশা? যে বাঙালি ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল তার কপালে এই দুর্ভোগের কারণ কী? তার আগে বলবো, আমাদের দেশটি স্বাধীনতার পর এই সেদিন ও ভাষার ব্যাপারে ছিল সচেতন। যেসব আন্দোলন সর্বজন স্বীকৃত যে দিবসটি দল মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই পালন করে তার নাম একুশে। অথচ সেটি ই এখন আক্রান্ত। ভাষা দিবসের মহান দিনটিতে আমাদের দুঃখ করে বলতে হচ্ছে, তারুণ্য মাতৃভাষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আসলেই কি এজন্য তারা দায়ী?
বলতে হবে মূল সমস্যার শুরু আগে হলেও সবচেয়ে বদ আছড় পড়েছে ডিজিটাল দুনিয়া খুলে যাবার পর। যেই না এই দুয়ার খুলেছে অমনি হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েছে বেনো জলের মতো যাবতীয় জঞ্জাল। একদিকে ধর্ম অন্যদিকে আগ্রাসন। এই আগ্রাসনে পাশের দেশের হিন্দি, মধ্যপ্রাচ্যের আরবি বা পাশ্চাত্যের ইংরেজি কিছুই পিছিয়ে নেই। ধর্মের ভাষা বলে হিন্দু সংস্কৃতকে, মুসলমান আরবিকে বৌদ্ধেরা পালিকে গুরুত্ব দেবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে গুরুত্ব আমরা দিচ্ছি না। দিচ্ছি আমাদের যুক্তিহীন আবেগকে প্রশ্রয়। অথচ শুদ্ধ আরবি জানা বা হিন্দ জানা ইংরেজি লিখতে পারা একটি গুণ। সে কাজে নাই আমরা। আছি নিজের ভাষার বারোটা বাজানোর জন্য নানা রকম ধান্দায় । যখন থেকে এবস চালাকি আমাদের ভাষাকে আক্রমন করতে শুরু করলো তখন থেকেই বিপদের শুরু। এখন তা এমন এক পর্যায়ে তারুণ্যের কথা শুনলে আপনি বুঝতেই পারবেন না তারা কি আদৌ বাংলায় কথা বলছে না অন্য কোনো ভাষায়।
সংস্কৃতির বড় পরিচয় তার ভাষা ভাষার সৌন্দর্যে। যেকোনো একটি ভাষা গড়ে ওঠে এবং তার সঠিক রূপ নেয় কাল থেকে কালান্তরে। সে কালান্তরের আগেই আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে ভাষার টুঁটি চিপে ধরতে দেখলাম। একসময় টেলিভিশন নাটকে সংলাপের ক্ষেত্রে ‘প্রমিত’ বাংলা ভাষার শক্তিশালী অবস্থান থাকলেও এখন চলিত ও আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারই চোখে পড়ে বেশি। এ বিষয়টি নিয়ে অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে বেশ বিরোধও চোখে পড়ছে। কেউ বলছেন, জাতীয় গণমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশনে একটি মান ভাষা বজায় রাখা প্রয়োজন; আবার কেউ বলছেন আঞ্চলিক ও কথ্য ভাষাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। বাংলা ভাষা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বর্তমানে। ভাষা বিকৃতির মহোৎসব চলছে চারদিকে। ঘরের ড্রয়িং রুম থেকে শুরু হয় এই বিকৃতি। পথে নেমে কান পাতলে শোনা যায় আরও শত রকমের বিকৃত বাংলা উচ্চারণ। একটি দেশের প্রজন্মের বড় একটি অংশ শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণে কথা বলতে পারেন না। এদের অনেকের কাছেই ইংরেজি ও বাংলার মিশ্রণে তৈরি নতুন ধরনের ভাষা প্রিয় হয়ে উঠছে।
এর ভোক্তা বা ব্যবহারকারী তারুণ্য জানে না এর মাধ্যমে তাদের কী ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে। মজা করে বলতে বলতে বা নাটকে বলাতে বলাতে এটা এখন সবার কথ্য ভাষায় পরিণত হয়ে গেছে। এমন কি লিখতেও কসুর করছে না অনেকে। মজার ব্যাপার যারা এর প্রবক্তা বা চালু করেছেন তারা তারুণ্যকে এগুলো গছিয়ে নিজেরা কিন্তু সৃষ্টিশীলতা চালু রেখেছেন পরিমিত প্রমিত গদ্যে। ভাষায় সাম্প্রদায়িকতা বলে একটা কথা চালু আছে। আমাদের রাজধানীর কিছু কথিত ভারত বিদ্বেষী তার সুযোগ নিয়েছে পুরোপুরি। এরা কলকাতার কাছে আত্মসমর্পিত। অথচ কলকাতার ভাষার সাধে পার্থক্য তৈরির নামে বিভক্তির দেয়ালে নতুন পেরেক ঠুকেছেন। যার শিকার কোমলমতি সন্তানেরা। তাদের মুখের ভাষা আজ বাংলা থেকে অনেক দূরে। আর একটা বিষয় হলো শিক্ষার মাধ্যম। ইংরেজি জানা মনীষীদের নাম জানলেই বোঝা সম্ভব তাঁরা যেমন ইংরেজি জানতেন তেমনি জানতেন মাতৃভাষা। মাতৃভাষায় দখল আর আধিপত্য ধাকলেই অন্যের ভাষা আয়ত্ত করা সম্ভব। শুধু ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখার নামে নির্দিষ্ট কিছু বইপত্র পড়ে মাকে মাম্মি, আর বাবাকে ড্যাডি ডাকলেই ইংরেজি শেখা হয় না। কী নিদারুণ বাস্তবতা। ভাই বন্ধুকে ব্রো, আর বোনকে সিস ডাকার এই কালে আমাদের ভাষা যে কোথায় মুখ লুকিয়ে কাঁদছে কেউ তা খেয়াল করে না।
ভাষা বিকৃতি ভাষা থেকে প্রজন্মকে দূরে রেখে কি আমরা আসলেই একুশের অর্জন ধরে রাখতে পারবো? আপনি দেখবেন মিডিয়াজুড়ে যে আবেগ বা অনুভূতি তার সিকি ভাগও বাস্তবে নেই। কেন নেই? আজকাল ইউটিউবের যুগ। খুললেই পাবেন নানা ধরনের মুখরোচক খবর। তাতে দেখবেন সাংবাদিক বা প্রশ্নকারীর মুখোমুখি একজন তরুণ-তরুণীও সঠিক ইতিহাস বা তথ্য জানে না। তারা একুশের দিনটি কেন কবে, কোথায় হয়েছিলÑ তাও বলতে পারে না। এমনই এক ভয়াবহ বাস্তবতার ভেতর এবারের একুশে আমাদের জন্য সতর্ক হবার ডাক নিয়ে এসেছে।
কে করবে সতর্ক? কারা নেবে দায়? আমি বলব এবারের একুশে আমাদের ঘরে পরিবারে সমাজে সতর্ক হবার ডাক দিচ্ছে। দেশের বাইরে বরং পরিবারগুলো সন্তানদের বাংলা শেখানোর জন্য মরিয়া। দেশে ঠিক তার উল্টো। সরকারকে মনে রাকতে হবে আধুনিক বাংলাদেশ বা স্মার্ট বাংলাদেশ মানে সড়ক রাস্তাঘাট বা যান্ত্রিক উন্নয়ন মাত্র নয়। আত্মিক বিস্তার আর মাতৃভাষার বিস্তার না ঘটলে কোনো জাতি এগোতে পারে না। আমাদের দেশটি নয় নয় করে ৫২ বছর পেরিয়ে এসেছে। অথচ এখনো আইন, বিজ্ঞান, সাহিত্য বা নানা বিষয়ে আমাদের ভাষায় কোনো সুলিখত বই নেই। নেই তেমন উদ্যোগ। ছোট একটি দেশ চেক প্রজাতন্ত্র সে দেশের এক বাঙালি জানা অধ্যাপক এসেছিলেন ঢাকার বই মেলায় তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন, এতো সমৃদ্ধ ভাষা আন্দোলনের পরও আপনাদের দেশে মাতৃভাষায় বিভিন্ন বিষয়ে বই নেই, অথচ আমাদের ছোট্ট দেশে যা চাইবেন তাই পাবেন নিজের ভাষায়। একুশে ফেব্রুয়ারি অমর হোক। মুক্ত হোক বাংলা ভাষা।
লেখক ও কলামিস্ট। সিডনি,
অস্ট্রেলিয়া থেকে