জাপানের বাংলা কাগজ ও বাংলা একাডেমির ভূমিকা
প্রবীর বিকাশ সরকার
ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধা মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু ছিলেন অবিভক্ত বাংলার সন্তান। তিনি জাপানে আজকে কিংবদন্তি। ঐতিহাসিক দিল্লি এবং লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার আসামী পলাতক অবস্থায় ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে জাপানে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং এদেশেই তাঁর জীবনাবসান ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে। জাপানে তাঁর অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড আজ ইতিহাস। তার মধ্যে তিনি এশিয়ান অভিবাসীদের জন্য একটি মাসিক (?) ইংরেজি কাগজ অঝওঅ প্রকাশ করেছিলেন কিছুদিন বলে তথ্য অবগত হওয়া যায় জাপানিদের স্মৃতিচারণে। বাংলা না হলেও একজন বাঙালি প্রবাসে জার্নাল প্রকাশ করেছিলেন বিংশ শতকের প্রথমদিকে এটি ঐতিহাসিক ঘটনা। জার্নাল ছাড়াও তিনি ১৩/১৪টি গ্রন্থ জাপানি ও ইংরেজিতে লিখে রেখে গেছেন। সেই সময় অন্য কোনো দেশে এমন ঘটনা কোনো বাঙালি ঘটিয়েছেন বলে আমার অতন্ত জানা নেই।
রাস বিহারী বসুর পরে বহু বছরের ব্যবধানে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে কতিপয় প্রবাসী বাংলাদেশী তরুণ ছাত্র-শ্রমিক মিলে হাতে লিখে একটি জার্নাল প্রকাশ করে কিছুদিন বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেন। অ-৪ সাইজের ৮ পৃষ্ঠার সাদাকালো পাক্ষিক সোচ্চার কাগজটি হস্তলিখিত এবং ফুজি জেরক্স ফটো-কপিয়ার মেশিনে কপিকৃত। আমার সংগ্রহে যে সংখ্যাটি আছে সেটি ১ম বর্ষ, ৮ম সংখ্যা। কাগজটির বিষয়বস্তু অধিকাংশই রাজনীতি সম্পর্কিত। এরশাদীয় স্বৈরাচারী শাসন, রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থা, সামাজিক অস্থিতরতা এবং মৌলবাদী তৎপরতার সমালোচনাই বেশির ভাগ লেখার বিষয়। সম্পাদক ছিলেন মাহাবুবুর রহমান, নির্বাহী সম্পাদক নাজিম, সার্বিক তত্ত্বাবধানে মোঃ নূরুল আমিন, সহযোগিতায় নিজাম, তাহের, মাসুদ, সার্দ্দুল, মনি ও মুরাদ। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আমি প্রকাশ করি মানচিত্র ট্যাবলয়েডÑÑএটাই জাপানের প্রথম বাংলা ভাষায় আধুনিক অফসেট মেশিনে মুদ্রিত কাগজ। প্রথম সংখ্যা ৮ পৃষ্ঠা সাদাকালো। এরপর অনিয়মিতভাবে ৭/৮টি সংখ্যা প্রকাশ করি প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠা চার এবং ভিতর এক রঙে দ্বিগুণ পৃষ্ঠায়। ক্রমে একদিন মাসিক ম্যাগাজিনে রূপান্তরিত হয় মানচিত্র।
১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ঢাকা থেকে মুদ্রিত হয়ে জাপানে আসত। ৫২ পৃষ্ঠার এই ম্যাগাজিনের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন লেখক মঞ্জুরুল আজিম পলাশ ও কবি সাইফুল্লাহ্ মাহমুদ দুলাল। তখন জাপানে বাংলা পত্রপত্রিকা আসত না ফলে মানচিত্রই ছিল বেশ কয়েক বছর ধরে প্রবাসীদের একমাত্র নিয়মিত কাগজ। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং গবেষকদের বহু লেখা ও সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে তাতে। তথ্য, সংবাদ, ফিচার, নিয়মিত কলাম ছাড়াই প্রচ্ছদ প্রতিবেদন, বিশেষ প্রতিবেদন, প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এক হাজারের বেশি, সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে ২০০ জনের বেশি বিশিষ্ট ব্যক্তির। ছড়া, কবিতা ও গল্প অসংখ্য। মানচিত্র জাপান তো বটেই বাংলাদেশ, ভারত, বৃটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও আমেরিকাসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে প্রেরিত হতো এবং ব্যাপক পাঠকপ্রিয়কতা অর্জন করেছিল। ঢাকাস্থ জাপানি দূতাবাস, আমেরিকান কালচারাল সেন্টার এবং জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র কর্তৃক আগ্রহ প্রকাশ ও সংগ্রহ কাগজটির মান-মর্যাদায় অনন্য মাত্রা সংযুক্ত করেছিল। উল্লেখ্য যে, মানচিত্রের উপদেষ্টা ছিলেন স্বনামধন্য কবি ও সাংবাদিক শামসুর রাহমান এবং খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ডঃ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। ২০০২ খ্রিস্টাব্দে নানাবিধ কারণে প্রকাশনা স্থগিত করতে বাধ্য হই। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে তবুও দু’টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল সম্পূর্ণ চাররঙে গ্লোসি পেপারে। সম্ভবত ৫২ পৃষ্ঠার কোনো বাংলা কাগজ মানচিত্রের আগে বা পরে এখনো বহির্বিশ্বের কোনো দেশে প্রবাসীরা প্রকাশ করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। মানচিত্র প্রকাশের পর আরও একাধিক মাসিক কাগজ জাপান থেকে প্রকাশিত হতে থাকে। জাপানে তখন প্রবাসীর সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি। প্রায় সবগুলো কাগজই বাংলাদেশ থেকে মুদ্রিত হয়ে জাপানে আসত।
১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে কবি ও লেখক এমএইচ কবীর প্রকাশ করেন অবয়ব। সংগৃহীত ৪৮ পৃষ্ঠার এই কাগজটির দু’টি ১ম বর্ষ, ৫ম ও ৬ষ্ঠ সংখ্যার প্রচ্ছদ ও ইনার মিলিয়ে এক ফর্মা চাররঙা, ভিতর একরঙা। বাংলাদেশের বরেণ্য কবি, সাংবাদিক, লেখকরা লিখেছেন। ৫ম সংখ্যায় প্রবন্ধ লিখেছেন শওকত ওসমান, কাবেরী গায়েন, দেবী রায়, দেবব্রত মল্লিক। কবিতা লিখেছেন শামসুর রাহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, হেলাল হাফিজ, ফরহাদ মজহার, কাহলিল জিবরান (অনুবাদ: অধ্যাপক কবীর চৌধুরী)। ৬ষ্ঠ সংখ্যায় লিখেছেন ইতিহাসবিদ ডঃ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ও আহমেদ ফারুক হাসান। কবিতা লিখেছেন রফিক আজাদ, আজফার হোসেন, সিকদার আমিনুল হক, আলতাফ হোসেন ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়। শহীদ জননী জানাহারা ইমামের সাক্ষাৎকারটি একটি অমূল্য বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় আরও একটি ম্যাগাজিন বাংলার মুখ নামে। চাররঙা প্রচ্ছদসহ ৩৬ পৃষ্ঠার সাদাকালো কাগজ। সম্পাদক অপু সারোয়ার। সংগৃহীত আছে ১ম বর্ষ, ৩য় সংখ্যাটি। এই সংখ্যায় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে নিয়ে সমালোচনামূলক একটি চমৎকার লেখা লিখেছেন বিশিষ্ট তরুণ কবি মোহন রায়হান। বাজেট বিশ্লেষণ করেছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। “গণআদালতঃ পটভূমি এবং অতঃপর: গণআদালতের ২৪ জন ও ঘাতক গোলাম আযম” শীর্ষক প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে ৩২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির মতামত তুলে ধরা হয়। বাংলার মুখের বাংলাদেশ ব্যুরো প্রধান ছিলেন কবি মোহন রায়হান।
১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় নতুন একটি ম্যাগাজিন চেতনা, যার সম্পাদক নূরুল আবেদীন। সংগৃহীত ১ম সংখ্যাটির প্রচ্ছদ ছাড়া বাকি ৩৪ পৃষ্ঠা সাদাকালো। এই সংখ্যাটি উদ্বোধনী সংখ্যা হিসেবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কেননা বিশিষ্ট লেখকরা একে অলঙ্কৃত করেছেন, যেমন ডঃ কবীর চৌধুরী, ফয়েজ আহমেদ, ব’নজীর আহমদ, খান আতাউর রহমান, শামসুজ্জামান খান, সুকুমার বড়ুয়া, পান্না কায়সার, ডঃ মুনতাসীর মামুন, সুশান্ত মজুমদার, জুয়েল আইচ, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, বিরূপাক্ষ পাল, খোশনূর আলমগীর, আসলাম সানী, মোঃ আব্দুল আজিজ ও মনিরুদ্দিন ইউসুফ। প্রত্যেকটি প্রবন্ধই সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে তথ্যসমৃদ্ধ এবং মূল্যবান। ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে জাপানে আমরা কয়েকজন মিলে গঠন করি আড্ডা টোকিও নামে একটি সৃজনশীল পাঠচক্র। এর মুখপত্র ছিল অনিয়মিত ট্যাবলয়েড আড্ডা টোকিও নামেই। সম্পাদনা করেছিলাম আমি, প্রকাশ করেছিল বন্ধুবর কবি মোতালেব শাহ্ আইয়ুব। আড্ডা টোকিও পাঠচক্র জাপানসহ অন্যান্য দেশেও বেশ আলোড়ন তুলেছিল। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে কবি নির্মলেন্দু গুণ এবং পরবর্তী বছরে কবি সমুদ্র গুপ্তকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম যথাক্রমে প্রথম বাংলা কবিতা উৎসব এবং জাপান-বাংলা কবিতা উৎসবে। সংগ্রহে রাখা দু’টি সংখ্যায় যথাক্রমে লিখেছিলেন প্রথিতযশা সাংবাদিক নির্মল সেন, পিআর প্ল্যাসিড, নিয়াজ আহমেদ জুয়েল, হারুনূর রশীদ, সজল বড়ুয়া, বাবলু রহমান, মাসুদুর রহমান, হরিপদ রায়, বেলাল বেগ, ডঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখ।
১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে পর পর আত্মপ্রকাশ করে চারটি মাসিক ম্যাগাজিন। শাপলা, সময়, প্রবাহ ও মাকু। শাপলার সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন মোল্লা জাহাঙ্গীর আলম। মূলত আওয়ামী ঘরানার এই কাগজটির ১ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যায় তৎকালীন দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ থাকলেও সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর দু’টি নিবন্ধ অত্যন্ত মূল্যবান। সময় এর সম্পাদক গাজীউর রহমান চৌধুরী। ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যায় কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসানের রাজনৈতিক নিবন্ধটি তাৎপর্যপূর্ণ। গল্প লিখেছেন মাহমুদ উল্লাহ। ক্রিকেট নিয়ে লিখেছেন দুলাল মাহমুদ। সংবাদ পাঠিকা রুখসানা আনোয়ারের সাক্ষাৎকার আজ বিস্মৃত সময়ের স্মৃতিই বটে। বাংলা-ইংরেজি দ্বিভাষিক প্রবাহের ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য কিছু লেখা রয়েছে যেমন “সংসদ নির্বাচন ’৯৬” নিয়ে লিখেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক মোস্তফা হোসেইন, সঙ্গে মাসুক হেলালের ইলাস্ট্রেশনগুলো অর্থবহ, চমৎকার। অর্থনীতি নিয়ে লিখেছেন বিশিষ্ট কলামিস্ট বিরূপাক্ষ পাল। নিয়ামত হোসেনের প্যারোডি, পপসাহিত্য নিয়ে লিখেছেন মাহমুদ শামসুল হক, মুগ্ধকর ভ্রমণকথা লিখেছেন ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী। মাকুর প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন আলোকচিত্র গ্রাহক মশিউর রহমান পারভেজ। ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যাটির প্রচ্ছদ ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয় ফ্যাশন মডেল বিবি রাসেলকে নিয়ে। প্রচ্ছদ প্রতিবেদন গ্রামীণ চেক কাপড় নিয়ে। প্রভাবশালী সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান লিখেছেন গুরুত্বপূর্ণ দু’টি নিবন্ধ। ঐতিহ্যবাহী জাপানি ফুলচর্চা “ইকেবানা” নিয়ে ফিচার, উমা মিত্রের গল্প এবং সাংবাদিক শাহজাহান সরদারের জাপান ভ্রমণ হৃদয়গ্রাহী। নারীবাদী নেত্রী পান্না কায়সারের সাক্ষাৎকার একটি ঐতিহাসিক দলিল। এই চারটি কাগজই কালার প্রচ্ছদ এবং ভিতর সাদাকালো, পৃষ্ঠা ৩৬ থেকে ৫২।
১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় এসএইচএম তসলিমউদ্দিন সম্পাদিত নিউ অয়নÑÑকালার প্রচ্ছদ, ভিতর সাদাকালো ৩৪ পৃষ্ঠার ১ম সংখ্যায় কয়েকটি মূল্যবান রচনা রয়েছে, যেমন সদ্যপ্রয়াত মহান মানবসেবী মাদার তেরেসা স্মরণে লিখেছেন ফারুক হোসেন ভুঁইয়া, নাচোল-তেভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তি নেত্রী ইলা বসুকে নিয়ে লিখেছেন রেহানা পারভীন, “আমার বাড়ী ফেনী” লিখেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক এবিএম মুসা, শতাব্দীর মহানায়ক সূর্যসেনকে নিয়ে লিখিত প্রবন্ধটি তথ্যসমৃদ্ধ। সম্পাদক আওয়ামীপন্থী বলেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ কাজ করেছে তার মননে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে মানচিত্রের কর্মী লেখক পিআর প্ল্যাসিড প্রকাশ করেন বাংলা-ইংরেজি দ্বিমাসিক বিবেকবার্তা মূলত সংবাদভিত্তিক কাগজ। ৩বর্ষ ১ম সংখ্যায় রয়েছে দেশ-বিদেশের অসংখ্য সংবাদ, ফিচার এবং প্রবন্ধ। প্রচ্ছদ চাররঙা ভিতর একরঙা সর্বমোট ৩২ পৃষ্ঠা। কাগজটি বেশ কয়েক বছর প্রকাশিত হওয়ার পর কিছুদিন বুকলেট হিসেবে প্রকাশিত হয়। এখন প্রকাশনা বন্ধ থাকলেও অনলাইন হিসেবে প্রকাশমান। ট্যাবলয়েড আকারেও মাঝে মাঝে দু-তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে।
২০০০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় মোঃ আসাদুজ্জামান সম্পাদিত প্রবাসী, ই-৫ সাইজের সম্পূর্ণ চাররঙা সর্বমোট ২০ পৃষ্ঠার এই কাগজটিতে রয়েছে তথ্যনির্ভর অনেক ছোট-বড় সংবাদ। যেমন ২০০০-১ অর্থবাজেট, মানব জেনোম, জাপানের নির্বাচন, জাপানি ভাষা শেখা, একজন জাপানি প্রতিবন্ধী তরুণের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা, বাস্কেটবল খেলোয়াড় হওয়াÑÑঅবিশ্বাস্যরকম উৎসাহব্যঞ্জক অথচ যার দেহের ৫টি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ৪টিই নেই! বিশ্ববিখ্যাত জাপানি কোম্পানি “সোনি”র পরিচিতিমূলক ফিচার “সোনি: উন্নতির পটভূমি”, সত্যি চমৎকার লেখা। ২০০২ খ্রিস্টাব্দে প্রবাসের ডাক নামে একটি বিএনপিপন্থী ত্রৈমাসিক কাগজ প্রকাশিত হয় এমডি আলাউদ্দিন সম্পাদিত। ইফতেখার রসুল জর্জ হচ্ছেন সমন্বয় সম্পাদক। চাররঙা প্রচ্ছদ, ভিতর একরঙা অত্যন্ত সস্তা কাগজে মুদ্রিত হলেও কিছু ভালো লেখা বিদ্যমান। লিখেছেন কবি ফরিদ কবীর, সাংবাদিক গাজীউল হাসান খান, ইফতেখার রসুল জর্জ এবং শুভ রহমান। কবিতা লিখেছেন আল মাহমুদ, দাউদ হায়দার, শাকিল রিয়াজ, মঞ্জুষদাশ গুপ্ত প্রমুখ।
২০০৩ খ্রিস্টাব্দে মানচিত্রের কর্মী লেখক কাজী ইনসান প্রকাশ করেন দ্বিমাসিক কাগজ পরবাস। প্রচ্ছদ চাররঙা, ভিতর একরঙা লিথোগ্রাফ মেশিনে মুদ্রিত ১ম সংখ্যাটি দ্রুত প্রবাসী পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। প্রচ্ছদসহ ৩৬ পৃষ্ঠার এই সংখ্যায় মানচিত্রের এক যুগ পূর্তি উপলক্ষে একটি বিশেষ নিবন্ধ লিখি আমি, সাংবাদিক মনজুরুল হক জাপানি সাংবাদিক নাওআকি উসুই এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে লিখেন মূল্যবান একটি নিবন্ধ। “লালসালু” নির্মাতা চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেলের মিনি সাক্ষাৎকারটি উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীতে জাপানেই কিছু পৃষ্ঠা চাররঙা ও বাকি পৃষ্ঠা একরঙা পরবাস কাগজ মুদ্রিত হয়েছে। সেসব সংখ্যায় প্রবাসীরা লিখেছেন তাঁদের মূল্যবান প্রবাস অভিজ্ঞতা এবং স্বদেশ ভাবনা নিয়ে।
আপাতশেষ কাগজটি প্রকাশিত হয় ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে ত্রৈমাসিক হিসেবে পূর্বদিগন্ত নামে, সম্পাদক ডঃ এমএএম মিলন। প্রচ্ছদ ও সেন্টার পেইজ চাররঙা এবং ভিতর একরঙা ৪৪ পৃষ্ঠার কাগজটি গ্লোসি পেপারে ঝকঝকে ছাপা ঢাকায়। ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যায় জাপানের বিভিন্ন তথ্যাদি নিয়ে চমৎকার একটি নিবন্ধ লিখেছেন মঞ্জুরুল হক, ধ্যান নিয়ে লিখেছেন চমন আরা যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, মানুষ ও কম্পিউটার সম্পর্ক নিয়ে ডঃ মোস্তফা আল মাসুমের লেখাটি মূল্যবান, ৎসুনামি (জলোচ্ছাস) নিয়ে লিখেছেন শহিদুল ইসলাম বাবু। এই সংখ্যার খুবই শিক্ষণীয় একটি বিষয় হলো: মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১টি সেক্টরের অবস্থান মানচিত্রে ব্যাখ্যার তথ্যচিত্রটি, যা সত্যি সংরক্ষণযোগ্য। এসব ছাড়া আরও দুটি কাগজ মাসিক বক্তব্য ও টোকিও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল যার কপি এখন খুবই দু®প্রাপ্য। বক্তব্য যথেষ্ট শক্তিশালী কাগজ ছিল। বেশ কিছুদিন প্রকাশিত হয়েছিল। এর প্রধান সম্পাদক ছিলেন নূর হোসেন দর্পন আর সম্পাদক ছিলেন কবি বিপুলকৃষ্ণ দাস। টোকিও সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন বর্তমানে জে-টিভি’র কর্ণধার মাসুদ আহমেদ।
একমাত্র দীর্ঘায়ুপ্রাপ্ত মানচিত্রকে বাদ দিলে আর সব কাগজই স্বল্পায়ু না হয় অনিয়মিত। অধিকাংশ কাগজই এক বছরের বেশি টিকেনি, কোনো-কোনোটি প্রথম সংখ্যার পরই মিলিয়ে গেছে। প্রকাশিত কাগজগুলো এখন কারোর সংগ্রহে নেই বললেই চলে। অথচ এই কাগজগুলো নানাদিক দিয়েই আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এবং অমূল্য সম্পদ। যদিওবা এগুলো পেশাদারী সাংবাদিক বা লেখকদের দ্বারা সুসম্পাদিত নয়, নয় তেমন আকর্ষণীয়, কিন্তু এগুলোতে ছিল বৈচিত্র্যময় বিস্তর তথ্য-উপাত্ত; প্রতিষ্ঠিত লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক তথা বুদ্ধিজীবীদের গুরুত্বপূর্ণ রচনা। ৯০ দশকের এই সময়ে বিশ্বের আর কোনো দেশে প্রবাসী বাঙালিরা এত বেশি কাগজ প্রকাশ করেছেন বলে জানা যায় না। মূলত অনাত্মীয় পরিবেশে প্রবল জাতীয়তাবোধ এগুলো প্রকাশের পেছনে কাজ করেছে। ব্যয় হয়েছে প্রচুর মেধা, সময় এবং অর্থ। তৎকালীন প্রবাসীদের তিক্ত-ঘামেসিক্ত অমানুষিক শ্রম, বিরূপ অভিজ্ঞতা, ভবিষ্যতমুখী স্বপ্নসাধ, স্বদেশের আর্থসামাজিক সমস্যা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, মৌলবাদী অরাজকতা, মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধসহ নানাবিধ বিষয় এইসব কাগজে বিধৃত হয়ে আছে।
অন্যদিকে, প্রায় সবগুলো কাগজই বাংলাদেশ থেকে মুদ্রিত হয়ে আসত বলে স্বদেশের আর্থিক খাতেও তাঁরা প্রচুর অবদান রেখেছেন। কাজেই তাঁদের সৃষ্ট এই সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদগুলো জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির সংগ্রহ করা উচিত বলে আমি মনে করি। সেইসঙ্গে একাডেমি প্রতিষ্ঠা করতে পারে একটি “প্রবাসী সাহিত্য-সংস্কৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্র।” প্রতি বছর একুশে বইমেলায় এগুলো প্রদর্শন করা গেলে দেশবাসী জানতে পারবেন যে মাতৃভাষা বাংলার চর্চায় প্রবাসীরা কতখানি নিবেদিতপ্রাণ। শুধু কাগজই নয়, অনেক প্রবাসী দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসে থেকে অনেক মূল্যবান গ্রন্থ লিখেছেন, গবেষণা করছেনÑÑসেগুলোকেও একাডেমি সংগ্রহ করতে পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। পুরস্কার দিয়েও উৎসাহিত, মূল্যায়ন করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এগুলো জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলা একাডেমির জাতীয় দায়িত্ব বলেই বিশ্বাস করি, কেননা ভবিষ্যৎ গবেষণার কাজে এগুলো হবে অসামান্য তথ্যের উৎস। ২০১০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে জাপানে এসেছিলেন বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক স্বনামধন্য লোকসাহিত্য গবেষক শামসুজ্জামান খান। তাঁর সঙ্গে এক সাক্ষাতে আমি এই প্রস্তাবগুলো দিয়েছিলাম। তিনি সঙ্গে-সঙ্গে বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে আমাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় স্বদেশে ফিরে গিয়ে তিনি বিষয়টি বেমালুম ভুলে যান এবং জীবদ্দশায় আর কোনো সংবাদ তার কাছ থেকে পাইনি। বর্তমান মহাপরিচালক জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বিষয়টি ভেবে দেখবেন বলে আশা রাখি। লেখক : শিশুসাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক