পর্যবেক্ষণে মধ্যবয়স : সংকট মানুষকে জাগিয়ে তুলতে পারে
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
যারা ব্যক্তিখাতে চাকরি করেন তাদের বিষয়ে মিডলাইফ ক্যারিয়ার ক্রাইসিস নিয়ে আমি কিছু কথা বলেছিলাম। সাংবাদিক মুন্নি সাহা আমাকে বললেন, যারা মধ্য বয়সে পৌঁছেছে তাদের জীবনের সংকট নিয়েও কথা বলা দরকার এই সমাজে। আমি কোনো মনস্তত্ত্ববিদ বা বড় মাপের সমাজবিজ্ঞানীও নই। আমার নিজের কাছে মনে হয় যে আমি নিজেও জীবনের মধ্যভাগে পৌঁছে গেছি বা মধ্যভাগ পার হয়ে শেষের দিকে চলে যাচ্ছি। বিষয়টি হলো যে জীবন হয়তো ভালোই চলছিলো। দেখতে দেখতে ক্যারিয়ারের ৩০-৪০ বছর পার করে দিলেন। হঠাৎ একটি ছন্দপতন কিন্তু হয়। সেটি চাকরি বা ব্যবসা যেকোনো ক্ষেত্রে।
এই সময়টাতে পরিবারের সবার সাথে মনে হয় দূরত্ব তৈরি হতে চলেছে, কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। এমনকি বন্ধুদের সঙ্গও ভালো লাগছে না। এই যে দূরত্ব, এটি আসলে একটি মধ্যবয়সের সংকট। কোন বয়সকে মধ্য বয়স ধরবো সেটি নিয়ে আমাদের এখানে বিতর্ক আছে। তবে যেহেতু মানুষের গড় আয়ু এখন বেড়েছে সে হিসেবে ৪০-৬৫ বছর বয়সকে মধ্য বয়স হিসেবে ধরা যেতে পারে। এই বয়সে মানুষের জীবনে কিছু তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে এবং সেটি থেকে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক কিছু পরিবর্তন আসে, আবেগের জগতের পরির্তন হয় এবং একধরনের টানাপোড়েন তৈরি হয়।
এই টানাপোড়ণের মাঝে একজন মানুষ সম্পূর্ণভাবে নিজেকে নতুন করে বিকশিত হবার একটি সুযোগ দেখতে পায়। অনেকে আবার একদম বিষণ্নতার অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়। এই যে একটি দ্বৈত অবস্থা আসলে চট করে কোনোকিছুর সিদ্ধান্ত নেওয়া ভুল হয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হয়। তখন জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। এই বয়সের একট বড় ভাবনা হলো অতীতটাকে ভালো করে দেখা এবং তখন মনে হয় আমি এই কাজগুলো না করলেও পারতাম।
কখনো কখনো বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী বা আত্মীয়স্বজনের তুলনায় নিজেদের অনেক ব্যর্থ মনে হয়। এই ভাবনাটি খুব নেতিবাচক। কিন্তু মানুষের মধ্যে এই ভাবনাটি আটকানো যায় না। হঠাৎ তীব্রভাবে কোনোকিছু পেতে চাওয়ার আকাক্সক্ষা তৈরি হয়। সেটি না পেলে একরকম একাকীত্ব তৈরি হয়। মনে হয় যে নিজের জীবনের মান প্রত্যাশিত পর্যায়ে যায়নি। এতে করে কারণে বা অকারণে মেজাজ খিটখিটে হয় এবং একটি একঘেয়েমি জীবনের মধ্যে নিজেকে প্রবেশ করানো হয়। কিন্তু অনেকেই প্রশ্ন করে যে মিডলাইফ ক্রাইসিস বলে কি আসলেই কিছু আছে? তারা বলে মিডলাইফ আবার কী? মানুষের জীবনতো একটাই। শুরু ও শেষ। কিন্তু মধ্য একটি জীবনতো আসলেই আছে।
যেহেতু মধ্যজীবন আছে, তাই এটি নিয়ে একটু ভাবনা চিন্তা করতে হয়। আসল কথা হচ্ছে, এই সময়টাতে ভালো থাকতে হবে। ভালো থাকার প্রথম কাজ শরীরটাকে সুস্থ রাখা। শরীরের পাশাপাশি মনের দিক থেকে সতর্ক থাকা। অনেকে অন্যভাবে নিতে পারে আমার কথা। এই সময়ে হয়তো অনেকে প্রার্থনা বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যাওয়া অনেক বেশি পরিমাণে বাড়িয়ে দেয়। অসুবিধা নেই। কিন্তু অতিমাত্রায় সেখানে গেলে সারাক্ষণ দোজখের ভয়, নরকের ভয়, মৃত্যুর ভয় এগুলো আলোচনা হতে থাকে যার ফলে মানুষ আরো বিমর্ষ হয়ে পড়ে ও মানুষ আরো বেশি নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে শুরু করে। তাই আমার কছে মনে হয় যে সবকিছুর একটি পরিমিত চর্চা দরকার এবং সেটি যতটা সম্ভব ব্যক্তিগত পরিসরে।
সিনেমা দেখা একটি বড় কাজ এই সময়টাতে। সিনেমা মানুষকে উজ্জীবিত করে। একটু ঘুরেবেড়ানোর অভ্যাসও করতে হবে। নতুন কোনো শখ তৈরি করাও যেতে পারে। আমার পরিচিত একজন অবসরপ্রাপ্ত মানুষকে দেখেছি তিনি এতিমখানায় সময় দেন। সেখানে চোট বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা করে এবং সময় কাটিয়ে তিনি সবসময় প্রফুল্ল থাকেন। আমরা যাই করি না কেন, নিজেকে পরিপাটি রাখতে হবে। আমাদের মতো দেশে যেখানে রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্য কিছুই করে না, সেখানকার ব্যক্তিগত আর্থিক ব্যবস্থাপনা খুব জরুরি। কর্মক্ষেত্রের চাপ আছে যদি তখনো চাকরি বা ব্যবসাতে নিয়োজিত থকেন। অনেকে বিমর্ষ হয়ে যান এই বয়সটাতে। সন্তান এই সময়টাতে দূরে চলে যায় যা অনেক মানুষকে একাকিত্ব ডুবিয়ে ফেলে। কিন্তু মনে রাখতে হবে প্রতিটি মানুষের জীবন নিজস্ব। সন্তান আপনার কিন্তু তারও একটি আলাদা জীবন আছে। সুতরাং জীবনের পথ নির্ধারণের জন্য তাকে অনকে দূর যেতে হবে। আর এই ব্যপারগুলোকে স্বাভাবিকভাবে নিতে হবে। সংকট কিন্তু কখনো কখনো সমাধানেরও একটি রাস্তা তৈরি করে। এ কারণেই অনেকে বলে সংকট ভালো।
সংকট মানুষকে জাগিয়ে তুলতে পারে। তবে এটির একটি মর্মান্তিক দিক আছে যা হলো সংকটের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে ফেলা। আমি যদি জীবনের সাথে সংযুক্ত থাকি তাহলে সংকট আমাকে কাবু করতে পারবে না এবং এটিকে সংকটে ভেবে নেওয়া যাবে না। কিন্তু সংকটকে সংকটের জায়গায় না দেখে এটিকে যদি একটি বিপর্যয় হিসেবে দেখতে থাকি তাহলে একটি মর্মান্তিক পরিণতি ঘটবে। ক্রাইসিসের ক্ষেত্রে বলা হয় যে ক্রাইসিস হবে না, এই ভাবনাটিই একটি ক্রাইসিস। জীবনের ক্ষেত্রে একটি ব্যবস্থাপনার জায়গা সুস্থভাবে তৈরি করা দরকার। অন্যথায় অনেক সময় মানুষকে একটি মর্মান্তিক পরিণতি ভোগ করতে হয়।
পরিচিতি: সিনিয়র সাংবাদিক। সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ফেসবুক পেজের ভিডিও কনটেন্ট থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন সঞ্জয় চন্দ্র দাস