বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি : কীভাবে যেতে পারি বিশ্বের সেরাদের কাতারে?
রাগিব হাসান : বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইতিহাস কম সময়ের নয়। সবচেয়ে প্রাচীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ১০৩ বছর বাকিগুলোও ৭৫ বছর বা ৫০ বছর এমন হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি এখনো বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছাকাছি মানে পৌঁছায়নি। আর পুরো পদ্ধতিতেই অস্বচ্ছতা থাকার কাঠামোগত সমস্যা আছে, যা দূর করাটা খুব জরুরি। আজকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতির কাঠামোগত কয়েকটি সমস্যা ও তা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে আলোচনা করবো একটু। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজ হলো শিক্ষকতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে গবেষণা করা। কাজেই যোগ্যতা হিসাবে প্রথমেই আসে নিজের বিষয়ে কতটা দক্ষ এবং গবেষণা ও শিক্ষকতায় দক্ষতার কী ট্রাক রেকর্ড আছে সেটা। বিশ্বের অধিকাংশ জায়গায় শিক্ষক নিয়োগ করা হয় অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর রাংক থেকে যেখানে ন্যূনতম যোগ্যতা ধরা হয় পিএইচডি (অথবা সেই বিষয়ের টার্মিনাল ডিগ্রি), যার মাধ্যমে সেই বিষয়ে জ্ঞান এবং গবেষণার দক্ষতা নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষক নিয়োগ করা হয় লেকচারার পদ থেকে। যার যোগ্যতা হলো ব্যাচেলর্স বা মাস্টার্স থাকা। তাতে একসময়ে পিএইচডি করা লোকজন পাওয়া কঠিন ছিলো তাই ৫০ বছর আগের মডেল ছিলো সদ্য পাস করা কাউকে নিয়োগ দেওয়া যিনি পরে পিএইচডি করে নিবেন একসময়ে। কিন্তু বর্তমান সময়ে বিশ্বের অন্য সব দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় যখন খুব সিলেক্টিভভাবে পিএইচডি করা সেরা স্কলারদের নিয়োগ করছে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো আগের রীতিই রয়ে গেছে। ফলে গবেষণায় দক্ষতার ব্যাপারটি একেবারেই নিশ্চিত করা হয় না, আর শিক্ষকতায় অভিজ্ঞতার ব্যাপারটিও না। বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকা অবস্থায় তারা শিক্ষাছুটি নিয়ে বিদেশে যান পিইএইচডি করতে এবং ৪/৫ বছর তাদের জায়গায় অন্য কাউকে নিয়োগ করে ক্লাস পড়ানোর কাজটা চালাতে হয়।
প্রশ্ন হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পিএইচডি করবেন যদি এটা রীতি হয় তাহলে পিএইচডি ধারীদেরকেই নিয়োগ করা কি বুদ্ধিমানের কাজ না? পাশের দেশ ভারতের কথা ধরা যাক। ভারতের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখি। আইআইটি কিংবা এর কাছাকাছি টপ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কিন্তু সরাসরি পিএইচডি করাদের অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর পদে নিয়োগ করা হয়। আমাদের দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিৎ সেই পদ্ধতি অনুসরণ করা যদি আমরা অন্তত পাশের দেশগুলোর মানে পৌছাতে চাই। এবারে আসি নিয়োগ পদ্ধতি নিয়ে। বাংলাদেশের ইউনিভার্সিটিগুলোর নিয়োগ পদ্ধতি অনেকটা এরকম আবেদন করা লাগে কাগজে কলমে। আমি এই বছরে প্রকাশিত কয়েকটি বিজ্ঞপ্তি দেখলাম ৮ কপি করে কাগজ/আবেদনপত্র/সার্টিফিকেট/ডকুমেন্টস জমা দেয়া লাগবে (এই ডিজিটাল যুগে কাগজের ৮ কপি কেন দেয়া লাগবে সেটা রহস্য)। তার পরে ইন্টারভিউতে ডাকা হবে। লিখিত পরীক্ষা থাকতে পারে, তার পরে ইন্টারভিউ বোর্ড প্রার্থীদের ডাকবেন। এক এক করে প্রার্থীরা রুমে ঢুকবে, ভিসি বা ডিন এর নেতৃত্বে ইন্টারভিউ বোর্ড প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা নিবেন। ক্ষেত্র বিশেষে আগে থেকেই জানা থাকবে যে কারা নিয়োগ পাবে। তারপর ঘোষনা দেয়া হবে যে কাকে নেয়া হয়েছে।
পুরো এই পদ্ধতির গলদটা দেখতে পাচ্ছেন? এখানে কোথায় গবেষণা বা শিক্ষকতার দক্ষতা যাচাই করা হচ্ছে? কোথায় দেখা হচ্ছে এই প্রার্থী ক্লাসে পড়াতে পারেন কি না অথবা গবেষণা কী করেছেন? ১০-১৫ মিনিটের ভাইভাতে কি এগুলো যাচাই করা যায়? আর পুরো যাচাই এর কাজটা নির্ভর করছে ইন্টারভিউ কমিটির লোকজনের মেজাজের উপরে। আবার ক্ষেত্রবিশেষে তাদের কারো পছন্দের প্রার্থী থাকলে তো কথাই নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষক নিয়োগের পদ্ধতিতে কেবল একাডেমিক রেজাল্ট দেখা হয়। এতে একটা সুবিধা আছে যে খুব কড়াভাবে এই নিয়ম মেনে চললে বায়াস এড়ানো যায়, অবজেক্টিভভাবে নিয়োগ দেয়া যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো দুইজন প্রার্থীর একজনের জিপিএ ০.০৫ বেশি হলেই কি তিনি শিক্ষক হিসাবে বেশি ভালো হবেন? বড় সমস্যা এখানেই। এমন অবজেক্টিভ ক্রাইটেরিয়া ধরে শিক্ষক নিলেও তা কেবল একাডেমিক রেজাল্টের ক্ষেত্রে খাটে। গবেষণা বা শিক্ষকতার দক্ষতার কোনো বিচার এভাবে করা যায় না। বিভাগের সেরা ছাত্রটি কিন্তু পরে সেরা শিক্ষক নাও হতে পারেন। কাজেই সমস্যাটা থেকেই যাচ্ছে এবং এটা আসলে একটা কাঠামোগত সমস্যা।
আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে ছাত্র তার পরে চাকুরি প্রার্থী এবং বর্তমানে ফ্যাকাল্টি সার্চ কমিটির সদস্য হওয়ার সুবাদে এখানকার শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতির ভিতর-বাহির সম্পর্কে খুটিনাটি অভিজ্ঞতা আছে। দেখা যাক এখানে (এবং অন্যান্য অনেক দেশেই) কীভাবে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়- [১] প্রথমেই জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোনো একটি প্রকাশনায় (একেক সাবজেক্টের টপ জার্নাল/অ্যাসোসিয়েশনের সাইটে) বিজ্ঞাপন দেয়া হবে। বিজ্ঞাপনের মধ্যে চাকুরির যোগ্যতা এবং কী কী সাবজেক্টের এক্সপার্টদের দরকার তা বলা থাকবে। [২] সার্চ কমিটি গঠিত হবে। যার সদস্য হবেন যে ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক নেয়া হবে সেখানকার সিনিয়র শিক্ষকদের নিয়ে। [৩] আবেদনপত্র অনলাইনে জমা দিতে হবে। জমা দেয়ার পরে সার্চ কমিটি সব আবেদন যাচাই বাছাই করে দেখবে এবং সুনির্দিষ্ট নিয়মে শর্ট লিস্ট করবে। আবেদনের সময় কাভার লেটার, সিভি, রিসার্চ স্টেটমেন্ট, টিচিং স্টেটমেন্ট, এবং রেকমেন্ডেশন লেটার জমা দিতে হবে। ক্ষেত্রবিশেষে রাইটিং স্যাম্পল যেমন রিসার্চ পেপার এক বা একাধিক আপলোড করতে হবে। [৪] শর্টলিস্টেড ক্যান্ডিডেটদের জুম বা ফোন ইন্টারভিউ নেয়া হবে। সবাইকে একই প্রশ্ন করা হবে। [৫] এর পরে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে ডাকা হবে। যাতায়াত ও হোটেল সহ যাবতীয় খরচ ইউনিভার্সিটি বহন করবে।
[৬] ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ হয় ১ বা ২ দিন ধরে। ইন্টারভিউয়ের দিন প্রার্থী সারাদিন ধরে নানা প্রফেসরের সাথে এক এক করে দেখা করে আধা ঘণ্টায় নিজের গবেষণা ও শিক্ষকতা নিয়ে কথা বলেন। এবং ডিপার্টমেন্টে একটি রিসার্চ সেমিনার দেন ঘণ্টা খানেক ধরে। এই সেমিনার লেকচারের মাধ্যমে তার পড়ানোর দক্ষতা এবং গবেষণার পরিধি সম্পর্কে সবাই ধারণা পান। এ ছাড়া ক্যান্ডিডেটকে লাঞ্চ ও ডিনারেও নিয়ে যায় ফ্যাকাল্টিদের এক বা একাধিক প্রফেসর। সেখানে গল্পের ছলে কথা বার্তা বলে প্রার্থীর সম্পর্কে আরো বোঝা যায় কেমন মানুষ, কলেজিয়াল কি না (সোজা বাংলায় খাপ খাইবে কি না)। [৭] এর পরে সার্চ কমিটি এবং ডিপার্টমেন্টের প্রফেসরেরা মিলে আলোচনার মাধ্যমে ক্যান্ডিডেটদের রাংকিং করেন এবং তাদের সুপারিশ দেন। ডিপার্টমেন্টের চেয়ার এখানে সাধারণত সিদ্ধান্ত নিজে দেন না সার্চ কমিটির সিদ্ধান্তই মেনে নেন (আর উপরের লেভেল যেমন ডিন বা প্রভোস্ট বা প্রেসিডেন্ট থেকে তো কিছু বলার প্রশ্নই আসে না)। এই পুরো পদ্ধতিটা প্রচণ্ড স্বচ্ছ।
সার্চ প্রসেস নিরপেক্ষ রাখার জন্য রীতিমত ট্রেনিং করতে হয় কমিটির সবাইকে। আর আমাদের সার্চ কমিটি ঠিকমত নিয়ম মেনে কাজ করছে কি না তা দেখার জন্য বাইরের ডিপার্টমেন্টের একজন প্রফেসর একুইটি এডভাইজর হিসাবে আছেন। একটা ব্যাপার পই পই করে বলে দেয়া হয় যে কোনো রকমের বৈষম্য করা যাবে না। প্রার্থীদের কাউকে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা নিষিদ্ধ (বাড়ি কই, বিয়ে হয়েছে নাকি, বাচ্চা আছে নাকি, এইসব বলা মানা)। এমনকি প্রার্থীদের বর্ণ, বয়স, জেন্ডার, অথবা নাগরিকত্ব কী তাও জিজ্ঞেস করা তো দূরের কথা, গুগল করে খুঁজে দেখাও মানা যাতে করে কাউকে বৈষম্যের শিকার হতে না হয়। এবং পুরো পদ্ধতিটি সময়সাপেক্ষ। আমাদের সার্চ প্রসেস এবারে শুরু হয়েছে গত বছরের আগস্ট মাস থেকে। আর চলবে এই বছরের এপ্রিল পর্যন্ত। কারণ একজন শিক্ষককে নিয়োগের ব্যাপারটা এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে অনেক সময় ব্যয় করে এই ব্যাপারটা করা হয়। যাতে করে নিশ্চিত করা যায় যে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকটি পড়াতে জানেন এবং গবেষণায় সুদক্ষ। আমরা চাই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাতারে আসুক। কিন্তু সেটা করতে হলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। এক লাফে গাছের আগায় চড়া যায় না। কিন্তু আমরা যখন দেখি আমাদের পাশের দেশগুলো আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে এইভাবে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেনো পিছিয়ে থাকবে? লেখক: শিক্ষক ও গবেষক। ফেসবুক থেকে