বিশ্বায়নসহ ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার আধিপত্যে বাংলা ভাষা প্রবলভাবে রূপান্তরিত হচ্ছে
সায়েমা খাতুন
গত কয়েক দশক ধরে বাংলা ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে অনেক বড় বড় বদল আসছে। বিশ্বায়নের চাপ এবং ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার আধিপত্যে বাংলা ভাষা প্রবলভাবে রূপান্তরিত হয়ে চলেছে। প্রাতিষ্ঠানিক ভাবেই বানানরীতির আমূল বদল আনা হয়েছে। আবার কথ্য বাংলায় অনায়াসে প্রচুর ইংরেজি পদের ব্যবহার স্বাভাবিক হয়ে গেছে।সুশীল ভদ্রলোকের নাগরিক বাংলাকে কৃত্রিম ও জনবিচ্ছিন্ন বলে এখন বিরাগও প্রবল।সাহিত্যের ভাষায় এবং মিডিয়ায় সুশীল বাংলার ব্যবহারকে অহরহ কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে। সামাজিক গণমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুকে বাংলা লেখালেখির এক রকম বিস্ফোরণই ঘটেছে। বলা চলে, ডিজিটাল নাগরিকদের আত্মপ্রকাশে বাংলা ভাষায় মত-ভাব-ভাবনার প্রকাশ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। যার মুখোমুখি হওয়ার সময় আমরা একবার এই জলধি তরঙ্গে ডুবে যাচ্ছি, এবং ভেসেও উঠছি। আমার কাছে এই সময়টাকে সৃষ্টির পূর্ববর্তী বিশৃঙ্খলার মত বোধ হয়। একটা বড় ধরনের রূপান্তরন দৃশ্যমান হল, পশ্চিমবঙ্গের বাংলাকে মান ধরে নেয়ার কলোনিয়াল অভ্যাস থেকে অনেক দূরে সরে আসা সম্ভব হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশী মানুষ যে ভাষাগুলোতে কথা বলে তার মধ্যে বাংলা ভাষার স্থান ৭ম। পৃথিবীতে মোটামুটি ২৬,৫০,০০,০০০ মানুষ বাংলায় কথা বলে। এর মধ্যে ২২,৮০,০০,০০০ জনের প্রথম ভাষা এবং আরও ৩,৭০,০০,০০০ জনের দ্বিতীয় ভাষা বাংলা। বাংলার সীমানা পেরিয়ে বৈশ্বিক কজমোপলিটান লন্ডন, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি, লস এঞ্জেলেস, টরোন্টো, প্যারিস, সিডনী, বার্লিনের মত শহরগুলোতে আমরা ধীরে ধীরে একটা ভিন্ন ধরনের বাংলা কমিউনিটি গড়ে উঠতে দেখতে পাচ্ছি। এই বাংলাভাষী কমিউনিটিগুলো নতুন দেশে নতুন ধরনের জীবনাচারে নিজেদের মানিয়ে নিতে নিতে নিজেদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকেও বিশ্বময় ছড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলা খাবার, পোশাক, আচার উৎসবকে একটা কজমো জীবনধারায় নিয়ে আসছে। এই বড় বড় বৈশ্বিক শহরগুলোর বহুত্ববাদী সংস্কৃতির বুনটের ভেতর বাঙ্গালীরা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চায় একটা নতুন চেতনার আভাস ফুটে উঠেছে। বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের নতুন এক ধরনের চর্চা গড়ে উঠছে। এই সব দেখে শুনে, এমন ভাবা কি ন্যায় সঙ্গত হবে যে, কয়েক প্রজন্ম পরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কি নতুন নতুন কেন্দ্র বাংলার বাইরে গড়ে উঠার সম্ভাবনা আছে কিনা?
বাংলাদেশীরা এখন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে একটা উল্লেখযোগ্য ডিয়াস্পরা বা দেশান্তরী জনগোষ্ঠী সৃষ্টি করেছে, যাদের অনাবাসী বাংলাদেশীও বলা হচ্ছে। ২০১৫ সালে এই ছড়িয়ে পড়া দেশান্তরী বাংলাদেশীরা দেশে ১৫.৪ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন।বিরাট বড় একটা দেশান্তরী বাংলাদেশী গোষ্ঠী কর্মরত আছেন সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে এবং সারা বিশ্ব জুড়ে। বাংলাদেশ সরকার এবং টঘউচ এর যৌথ হিসেবে বলা হয়েছে, ২৪,০০,০০০ বাংলাদেশী অভিবাসী অথবা স্থায়ী কর্মী হিসেবে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী অভিবাসীর সংখ্যা প্রধানত ১৯৭০ এর দশক থেকে বাড়তে শুরু করে, ২০০০-২০১৫ সালের দিকে ৫৭,০০০ থেকে ১,৮৮,০০০ জনে পৌঁছায়। এদের প্রথম ভাষা বাংলা।
বাংলার বাইরে বাংলা ভাষার চর্চার ক্ষেত্রে প্রধান ভাবনা হল, অভিবাসী পরিবারের বাচ্চাদের বাংলা ভাষা শেখানো।এই ভাষা শেখানোর জন্যে এই সব শহরগুলোতে কমিউনিটির উদ্যোগে অনেক অনেক বাংলা স্কুল গড়ে উঠেছে, যেগুলোকে ভাষা-শিক্ষণ বিদ্যায় বলা হচ্ছে পরম্পরাগত ভাষার বিদ্যালয়। এই স্কুলগুলোর কোন কোনটির বয়েস ৩ থেকে ৪ দশক পর্যন্ত। বাংলা স্কুল ছাড়াও বইমেলা, বাংলা পত্রিকা, সাহিত্য সংগঠনও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাঙ্গালী অধ্যুষিত মহানগরগুলোতে যারা নিয়মিতভাবে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে যাচ্ছে। বাংলার বাইরে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার ঘটিয়ে চলছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে এই সব উদ্যোগগুলোর সাথে কোন কার্যকর যোগাযোগ বা সমর্থনের কর্মসূচি নেই বললেই চলে।
আমরা উইস্কন্সিনে বসাবাসরত বাংলাদেশীরা স্বেচ্ছাশ্রমে একটা বাংলা স্কুল ২০১৫ সাল থেকে কমিউনিটির উদ্যোগে চালিয়ে আসছি। এই অক্ষর বাংলা স্কুলে শিক্ষার্থীদের সামনে আমাদের প্রথম যে প্রশ্নটার মুখোমুখি হতে হয়, তা হল, কেন আমাদের বাংলা শেখা দরকার?পড়িবারগুলো ভাবছে, এখানে বড় হওয়া বাচ্চারা বাংলা শিখে কি করবে? আমেরিকা-কানাডায় বড় হওয়া বাচ্চারা কেন আদৌ বাংলা শিখতে যাবে? বাংলা ভাষার প্রতি ভালবাসা ছাড়া বাংলা শেখার জাগতিক ও প্রায়োগিক সুবিধা এই দেশে কিছু আছে কিনা? শিক্ষকেরা ভাবছেন, দ্বিতীয় ভাষা বা পরম্পরা ভাষা হিসেবে বাংলা শেখানোর চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে, বাংলা ভাষা শেখানোর প্রচলিত টেক্সট বইগুলো কি এই দেশে তেমন করে কাজে লাগবে? এই ভাষাশিক্ষণের বফধমড়মরপধষ এবং টেকনিক্যাল চ্যালেঞ্জগুলো কি? – এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমরা এখনও স্পষ্ট করে বলতে পারি না। কিন্তু আপাতত এই প্রশ্নগুলোই বাংলা চর্চায় একটা অগ্রগতির চিহ্ন বলে মনে করি। (লেখক: জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক)