খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় সাম্প্রতিক এই অবস্থান নিয়ে আত্মগ্লানি বোধ করছি
অভিজিৎ কুমার দেব
এলজিবিটিকিউ বহুজাতিক কোম্পানীর তৈরী কোন পণ্য নয়; এটা একটা শারীরবৃত্তিক বৈশিষ্ট; যেমন পঙ্গুত্ব একটা শারীরবৃত্তিক বৈশিষ্ট্য। মানুষ স্বেচ্ছায় অন্ধ হয় না; একজন স্ট্রেইট মানুষও স্বেচ্ছায় এলজিবিটিকিউ হয়ে যেতে পারে না। এলজিবিটিকিউ কিংবা পঙ্গু মানুষরা সব সমাজেই সংখ্যালঘু। প্রশ্ন হচ্ছে, সমাজের সংখ্যাগুরুরা এই সংখ্যালঘুদের নিয়ে কি করবে?
পশ্চিম ইউরোপের সমাজ ভাগ্যাহত পঙ্গুদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের স্বাবলম্বী জীবন যাপনের ব্যবস্থা করতে পছন্দ করে। ইউরোপে পঙ্গু মানুষদের স্বাবলম্বী করার জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা দেয়া হয়; চলাচলের জন্য উপযুক্ত ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরী করা হয়; সর্বোপরি সমাজের অন্যান্য মানুষের কাছে ডিসেবলদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরী করার জন্য স্কুলের কারিকুলামে সহিষ্ণুতা ও সহমর্মিতার শিক্ষা দেয়া হয়। পশ্চিম ইউরোপের উদার, কল্যাণমুখী ও মানববাদী সমাজ এলজিবিটিকিউ দের জন্যও একই নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করে।
বাঙালীর সমাজ ব্যবস্থা অনুদার, অসহিষ্ণু ও অদৃষ্টবাদী। বাঙালী ভাগ্যাহত সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানোর বদলে তাদেরকে নির্মম অদৃষ্ট বরণ করে নিতে উৎসাহিত করে; নিজে ভাগ্যাহতদের প্রতি সহমর্মিতার হাত প্রসারিত করে না; কোন ব্যক্তি সহমর্মিতা দেখলে তার বিরুদ্ধে বাঙালীরা সংঘবদ্ধ ভাবে অবস্থান নেয়। আমার প্রিয় খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি এই অবস্থান নিয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ছাত্র হিসাবে আমি আত্মগ্লানি বোধ করছি।
খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি টিইডিএক্স টকের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের এক বক্তার বিরুদ্ধে এলজিবিটিকিউ-দের প্রতি সহমর্মিতার অভিযোগ আসে; খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজকরা ঐ বক্তাকে বহিস্কার করে; ফলশ্রুতিতে টিইডি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই অনুষ্ঠান আয়োজনের লাইসেন্স বাতিল করে দেয়। এর প্রেক্ষিতে প্রচন্ড আপত্তিকর মন্তব্য করছেন কিছু ছাত্র। তারা বলছেন, টিইডি যদি বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী হয়, তাহলে তারা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতায় হাত দেয় কিভাবে? কারণ, বাকস্বাধীনতার একটাই সীমানা, তা হচ্ছে অপরের স্বাধীনতা হরণ করা যাবে না। কোন বক্তার বক্তব্য দেয়ার অধকার হরণ করা বাকস্বাধীনতার ধারণার পরিপন্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা মতের মানুষ নানা ধারণা নিয়ে আলোচনা করবে; বিতর্ক হবে; পুরানো ধারণা বাতিল হবে; নতুন জ্ঞানের উদ্ভব ঘটবে এমনটাই কাম্য।
ঘুষ খাওয়া, চুরি করা, বা দুর্নীতি করা অপরাধ। সেটা স্ট্রেইট বা এলজিবিটিকিউ সবার জন্যই। দুর্নীতি বা চুরি করার মতন অপরাধ না করলে দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তাদের প্রাইভেট জীবন কিভাবে যাপন করবেন সেই স্বাধীনতা তাদের। এই এলজিবিটিকিউ জনগোষ্ঠিকে একঘরে না করে বরং তাদের স্বাবলম্বী করা প্রয়োজন; তাদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরী করার জন্য স্কুলের কারিকুলামে সহিষ্ণুতা ও সহমর্মিতার শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন; তাহলেই বাঙালী সমাজ কল্যাণমুখী হবে।
বর্তমান সময়ে সহিষ্ণুতা ও সহমর্মিতার শিক্ষা বিশেষ ভাবে জরুরী। কেননা বর্তমানে বিপুল সংখ্যক বাঙালী পশ্চিমের সমাজে অভিবাসী হয়ে আসছে। বাঙালীদের অসহিষ্ণুতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার এই জঘন্য প্রবণতা ক্রমেই পশ্চিম ইউরোপের জনগোষ্ঠির কাছে প্রকাশিত হয়ে পড়বে। সঙ্গত কারণেই তখন পশ্চিমের মানুষের কাছে বাঙালীর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়বে। সকল অভিবাসীদের জন্যই সেটা এক অনভিপ্রেত ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
আমরা চাইব বাংলার ছাত্ররা সহিষ্ণুতা, সহমর্মিতা ও ইনক্লুসিভনেসের পক্ষে দাঁড়াবে; বাংলার ছাত্ররা বিদ্বেষ, অদৃষ্টবাদ ও সুপ্রিমেসীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে; তাহলেই বিশ্ব সভায় বাঙালীর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের ঊর্ধে থাকবে। (লেখক: প্রবাসী প্রকৌশলী)