সরকারের আয়ের মূল উৎস, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর ও জেনারেল সার্ভিস ট্যাক্স
কাজী এম. মুর্শেদ
কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কলিগ বললো, কফি খাবেন। রুমে বসতে বললাম। জিজ্ঞাস করলাম, গল্প করবেন, নাকি লেখাপড়া? বললো, স্যার ক্লাস নেন। কীসের উপর নেবো? বললো, ট্যাক্সে যে বলে রেট কমিয়ে নেট বাড়াতে, এর মানে কী? বললাম, বাংলাদেশের ট্যাক্স ব্যবস্থা একটা জঘন্য সিস্টেমে চলে। সরকারে বা অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ কোথাও কোনো লোক নেই, যারা ট্যাক্সের সমাধান দিতে পারেন। এসব আমলা যা কালিদাস মেঘদূত পড়ে বিসিএস অফিসার হয়েছে বা মন্ত্রী পর্যায়ে যেসব ব্যবসায়ীদের সমর্থনে এমপি, মন্ত্রী হয়েছে, কারো সেই ইচ্ছা থাকলেও বদলানোর সাহস নেই। এরপরের কথাগুলো আমার নিজের ক্লাসের অংশ। তারপরও ছাত্রছাত্রী যারা ক্লাস করতে বসেছে, তারা কতোটা বুঝেছে জানি না, আমার লেখা যারা পড়েন, দেখেন ধরতে পারেন কিনা।
সরকারের আয়ের মূল্য উৎস কর, এটা প্রত্যক্ষ কর বা পরোক্ষ কর। প্রত্যক্ষ কর হলো আয়কর, সেটা কোম্পানি কর বা ব্যাক্তি কর। আর পরোক্ষ কর হলো যা আমরা দিই, কিন্তু চোখে পড়ে না, যেমন ভ্যাট। বাংলাদেশ চলছে মূলত পরোক্ষ করের উপর, বিভিন্ন ব্যবসায়ী মহলের চাপে বা কর আইনের ফাঁক দিয়ে প্রত্যক্ষ কর আশানুরুপ হয় না। এর সাথে অর্থ পাচার ও দুর্নীতির বড় যোগাযোগ আছে। উদাহরণ দিই। পাশের দেশ ভারতে ভিডিঅইএস স্কিম আছে। আপনি যেকোনো উপায়ে যা আয় করেন যা আয়করে নেই, আপনি ভলেন্টারি ডিসক্লোজার স্কিমে তা ঘোষনা করে ৩৩ শতাংশ আয়কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করতে পারবেন, আপনার পুরো তথ্য সম্পূর্ণ গোপন রাখা হবে।
বাংলাদেশে এটা ১০ শতাংশ করা হয়েছিলো, তবে খুব কম লোক টাকা সাদা করে। সেইসাথে কোনো তথ্য গোপন থাকেনি। আমাদের সংসদে যখন গোপন মুচলেকা জনসম্মখে দেখানো হয়, সেখানে এই স্কিমে কে টাকা সাদা করলো সেটা এমনিই গোপন থাকবে না। আবার হাস্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিলো, বিদেশে পাচার করা টাকা সম্পত্তি বিক্রি করে দেশে ফেরত আনলে ৭ শতাংশ কর দিয়ে পুরো মাফ পাবে। এক টাকাও আসেনি। আসার কথা না, যেহেতু এটা আসার জন্য পাঠানো হয়নি। এবার আসেন অন্য কথা বলি, রেট কমিয়ে নেট বাড়ানো। কথাটার অর্থ হলো, ট্যাক্স রিটার্ন দেবে, সাথে ট্যাক্স দেবে আবার দিনে দিনে সংখ্যা বাড়বে। এর ভুক্তভোগি হয় সাধারণ জনগণ, পুরো সুযোগ নেয় সরকারি কর্মকর্তারা। বেতন ভাতা বাড়ানো ছাড়াও ট্যাক্স কমানোর চাপ চলে, সরকারের এই আমলা বা প্রশাসনের উপর তেমন জোর খাটাবার পরিস্থিতি নেই, সবই মেনে নিতে হয়। সেই সাথে ব্যবসায়িরাও সুযোগ নেয়। একটা উদাহরণ দিই। সংখ্যাটা কাছাকাছি, কিছু বদলাতে পারে।
সরকার চালাতে এবং বাজেটের আয় দেখাতে ট্যাক্স বলতে গেলে অন্যতম মাধ্যম। আমি সিঙ্গাপুরের উদাহরণ দিই। সেখানে বার্ষিক ট্যাক্স রিটার্ন জনগণ দেয় না, সেটা প্রতি কর্মীর সাথে আইআরএস বা ট্যাক্স অফিসের যোগাযোগ থাকে। অফিসের হিউম্যান রিসোর্স সরাসরি আইআরএসকে জানায়। কর্মীর সুযোগ থাকে কিছু খরচ বাদ দেবার, যেমন সন্তানের পড়াশোনা, নিজের ও পরিবারের জন্য সামান্য কিছু কমানোর। এসব হিসাবের পর আয় যদি ২০ হাজার ডলারের নীচে থাকে তাহলে কর দেয়া লাগে না। এর উপর গেলে ৪০ হাজার ডলার পর্যন্ত বছরে ৫ শত ডলার দিতে হয়। এরপরে ৮০ হাজার পর্যন্ত সম্ভবত ৩ শতাংশ দিতে হয় ওই ৪০ হাজারের উপরে। ৮০ হাজারের উপরে ৭ শতাংশ। এই হিসাব দুইপক্ষ একমত হলে ট্যাক্সের নম্বর ব্যাংকের সাথে যুক্ত, ব্যাংক তখন সরাসরি টাকা ট্যাক্স অফিসকে দিয়ে জানিয়ে দেয়। সিঙ্গাপুর সরকারের লজিকটা দেখেন। কোনো কিছু আয় হলে আপনি ব্যয় করবেন। তারা সরাসরি ট্যাক্সে জনগনের চেয়ে কোম্পানির আয়টাকে ট্যাক্সের আওতায় বেশি আনে।
ব্যক্তি যেহেতু প্রত্যক্ষ আয় করে, সে টাকা না থাকলে ব্যায় করবে না, সেজন্য ব্যয়ের সময় ৮ শতাংশ হারে জেনারেল সার্ভিস ট্যাক্স ধরে। যেকোনো বিল দিলে সেই দোকান রিসিট দিতে বাধ্য এবং এই জিএসটি মেশিন সরাসরি ট্যাক্স বিভাগে যুক্ত। তারা টাকা অনলাইনে সাথে সাথে পেয়ে যায়। কিছু এক্সেপশন আছে, যেমন আপনি বেড়াতে গেলে কাগজ সাথে রাখবেন, এয়ারপোর্টে জিএসটি রিফান্ড বুথ আছে, তারা নগদে ফেরত দেয়। রেট বাড়িয়ে ট্যাক্স বেশি যোগাড় করতে পারবেন না, বাঙালি অসম্ভব ধূর্ত, কোনো চিপাগলির রাস্তা বা সরাসরি ঘুষ বা প্রভাব খাটাবে। এই ১৫ শতাংশ ট্যাক্স কমানো উচিত এবং মিনিমাম লিমিট বাড়ানো উচিত। মানুষ ব্যক্তি হিসাবে যেনো প্রত্যক্ষ কর কম দেয়। আয় হলে ব্যয় হবে, সরাসরি জিএসটি বাড়িতে মনিটর করলেই সরকারের আয় চলে আসে। কোনো আমলা বা রাজনীতিবিদ নেই যে আমার এই হিসাব বুঝবে না, কিন্তু কেউ এটাকে পালনের জন্য সংসদে আইন করবে না। পুরো সংসদে ব্যবসায়ী বলা, তারা আইন করবে না। রেট বাড়ানো বুঝেছেন, নেট বাড়ানো মানে আওতা বাড়ানো- বাংলাদেশ চলে ২ শতাংশ মানুষের রিটার্ন ও ট্যাক্সে। এটাকে বাড়ানো দরকার। ট্যাক্স কমিয়ে আওতা বাড়ানো হলে সরকারের হিসাবে, ব্যাংক হিসাবে যুক্ত থাকবে, সাথে ব্যাংকের সাথে যুক্ত থাকবে। যা কথা বলি অর্থনীতি ঘিরে।
বাংলাদেশে বেশ কিছু অর্থনীতিবিদ আছেন, এর মধ্যে ৬০ শতাংশ কতোটুকু কী বোঝেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে। বাকি ২০ শতাংশ ভালো বোঝেন, তাদের কথা সরকার শোনে না। শেষ ২০ শতাশের কথা শুনে অবাক হই, উনাদের জ্ঞান থাকলেও বিভিন্ন চ্যানেলে বিভিন্ন কথা বলেন, সরকার যেনো নারাজ না হয়। এতে পদ, পদক, পদবি হারানোর ভয় কাজ করে। এজন্য কারি ফেভারের বাইরে যেতে অক্ষম। আমি মাঝের ভাগে পড়ি, যাদের কথা সরকার শুনবে না। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যখন জানি শুনবে না, তখন থেকে ফেসবুকে আপনাদের ফ্রি ক্লাস নিয়ে অর্থনীতি বোঝানোর কাজ করি। কোনো একদিন কোনো এক সরকার এসে এই লোকগুলোকে খুঁজে বের করে একেকটা উপদেষ্টা কমিটিতে জায়গা দেবে। বেঁচে থাকতে সে সম্ভাবনা পাচ্ছি না। সেজন্য পড়েন এবং কিছু শেখার পেলে শেখেন, না পেলে ধরে নিয়েন আমার প্রাথমিক ক্লাসের উপর আপনারা মাধ্যমিক পড়ছেন।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক