বাংলাদেশ ও ভারতীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে দানে-মানে ব্যবধান
ড. কামরুল হাসান মামুন
ভারতের বড় বড় ধনীরা বিদেশে টাকা পাচার করেন না। তারা ব্যাংক ডাকাতি করেন না। তাদের অনেকেই শিক্ষায় ডোনেশন দেয়। আমরা তো জানি টাটার কথা। ভারতের সবচেয়ে বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম হলো টাটা ইনস্টিটিউট ফর ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ, যেটি টাটা গ্রুপের অর্থে প্রতিষ্ঠিত এবং এর পেছনের ইন্টেলেকচুয়াল স্থপতি ছিলেন হোমি ভাভা। এছাড়া কলকাতায় ইন্ডিয়ান আসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ডা. মহেন্দ্রলাল সরকারের নেতৃত্বে মানুষের দানে। ইন্ডিয়ান স্টাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রশান্ত কুমার মহালানবীশের দানে এবং নেতৃত্বে। বর্তমানে ভারতের সেরা ধনীদের অন্যতম হলেন অুরস চৎবসলর অহফ ঋধসরষু। তারা সম্প্রতি ১ হাজার ৭ শত ৭৪ কোটি রুপি শিক্ষায় দান করেছে। ইরৎষধ অহফ ঋধসরষু প্রায় ৩০০ কোটি রুপি শিক্ষায় দান করেছে। সমপরিমাণ অর্থ আদানী পরিবারও শিক্ষায় দান করেছে। বাজাজ ফ্যামিলি ২৬৪ কোটি রুপি শিক্ষায় দান করেছে।
এবার বাংলাদেশের কথা ভাবুন। আমাদের সামিট গ্রুপ, আমাদের বসুন্ধরা, আমাদের বেক্সিমকো, আমাদের স্কয়ার, আমাদের এস আলমসহ আরো অনেকেই কী করেছে? এই দেশের ধনীরা প্রথমত চুরি-চামারি আর ডাকাতি করে ধনী হয় এবং এরপর বিদেশে অর্থ পাচার করে স্ত্রী সন্তানদের সেখানে পাচার করে। দেশকে দুধেল গাইয়ের মতো ব্যবহার করে। স্বাধীনতার পর একজনকে দেখলাম না বড় আকারে অর্থ দান করে বড় কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে। যদিওবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে, সেটাও গড়ে আরো অর্থ উপার্জনের জন্য। এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। ৫২ বছর হয়ে গেলো এখনো একটি গবেষণা ইনস্টিটিউট গড়ে উঠেনি। না সরকার, না ব্যক্তি এইদিকে ঝুঁকেছে। অথচ সরকার একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলছে কিন্তু এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যোগ্য শিক্ষক যোগান দেওয়ার জন্য একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আজও গড়ে উঠেনি। গবেষণায় উন্নতি না করে পৃথিবীর এমন একটি দেশও কি আছে যেই দেশ উন্নত হয়েছে। উন্নত লেখাপড়া বিহীন ধনী মানে সেই মানুষ হবে রাক্ষস, অসভ্য যার সব লক্ষণ এবং উদাহরণ বাংলাদেশে বিদ্যমান।
আমাদের মানসম্মত শিক্ষার যে অভাব আছে তা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ দেখলেই বোঝা যায়। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় মানে মারামারি, খুনাখুনি, দলাদলি আর চামচামি। আমাদের মানসম্মত শিক্ষার যে অভাব আছে তা আমাদের নোংরা রাস্তাঘাট, দূষিত খাল-বিল-নদী দেখলেই বোঝা যায়। আমাদের মানসম্মত শিক্ষার যে অভাব আছে তা আমাদের রাজনৈতিক মিছিল মিটিং ও পোস্টারের মান দেখলেই বোঝা যায়। আমাদের মানসম্মত শিক্ষার যে অভাব আছে তা আমাদের পত্রিকা ও টেলিভিশনের মান দেখলেই বোঝা যায়। এত দেখেও আমাদের বোধোদয় না হওয়া দেখেও বোঝা যায় আমরা কতটা অসভ্য। সব দেখে মনে হয় আমরা দেশের চেয়েও দলকে আর দলের চেয়েও নিজেকে বেশি ভালোবাসি। এইটা করতে গিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত অন্যকে আমরা বঞ্চিত করি, অন্যের অধিকার হরণ করি, অন্যের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলি। আমরা জানিনা যে অন্যরা ভালো না থাকলে আমি নিজে বা আমার সন্তানরা ভালো থাকার পরিবেশ পাবে না।
লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়