আইএসডিবি’র কাছ থেকে ২.১ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ
এস.ইসলাম জয় : [১] ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইএসডিবি) আগামী তিন বছরে তেল কেনার জন্য ১.৯ বিলিয়ন ডলার এবং এলএনজি কেনার জন্য ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইটিএফসি) থেকে অবশিষ্ট ১.৩ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রস্তাব করেছে।
[২] ২০২৪ সাল থেকে পরবর্তী তিনবছর বাংলাদেশকে ৪.৯ বিলিয়ন ডলারের বড় অঙ্কের ঋণ প্রস্তাব দিয়েছে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইএসডিবি) গ্রুপ। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তাদের মতে, এ ঋণ জ্বালানি ক্রয়, উন্নয়ন প্রকল্প এবং বেসরকারি খাতকে শক্তিশালী করার জন্য ব্যবহার করা হতে পারে।
[৩] জ্বালানি আমদানির প্রয়োজনীয়তা মেটাতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইটিএফসি) থেকে সম্প্রতি ২.১ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। গত ৭ ফেব্রুয়ারি আইটিএফসি এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের মধ্যে এ ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
[৪] টিবিএস এর প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের অব্যাহত ডলার সংকট এবং আমদানি বিল নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে চলমান চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় আইটিএফসি’র মাধ্যমে ঋণের প্রায় ৩.২ বিলিয়ন ডলার তেল ও গ্যাস ক্রয়ের জন্য বরাদ্দ করা হবে। আরও ১.৩ বিলিয়ন ডলার দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ব্যয়ের কথা রয়েছে। এর সুদের হার বাজারের বিদ্যমান হারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকবে।
[৫] ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, বেসরকারি খাতের উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা জেদ্দাভিত্তিক ইসলামিক কর্পোরেশন ফর দ্য ডেভেলপমেন্ট অব দ্য প্রাইভেট সেক্টর (আইসিডি)-এর মাধ্যমে ৪০০ মিলিয়ন ডলার ঋণের একটি প্রস্তাবও রয়েছে।
[৬] এ ঋণ প্রস্তাবের পাশাপাশি আইএসডিবি গ্রুপ তাদের বিমা শাখা ইসলামিক কর্পোরেশন ফর দ্য ইন্স্যুরেন্স অব ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট ক্রেডিট-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য আড়াই বিলিয়ন ডলার মূল্যের বিমা সুবিধা দেওয়ারও প্রস্তাব করেছে বলে জানিয়েছেন ইআরডির কর্মকর্তারা।
[৭] এ কর্পোরেশনের লক্ষ্য হলো শরিয়াহ-সম্মত ঝুঁকি প্রশমন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সদস্য দেশ ও বিশ্বের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগকে সহজতর করা। ঢাকায় আইএসডিবি রিজিয়নাল হাবের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক (আবাসিক প্রধান) মুহাম্মদ নাসিস বিন সুলাইমান ১৫ ফেব্রুয়ারি ইআরডি সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকীর সঙ্গে এক বৈঠকে এসব প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।
[৮] সৌদি আরব থেকে পরিচালিত গ্রুপটি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বাজারভিত্তিক ঋণ প্রদান করে। বর্তমানে এসওএফআর (সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট) বেশি হওয়ায় বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্পে সংস্থাটির কাছ থেকে ঋণ নেবে কি না কিংবা নিলে কী পরিমাণ নেবে তা ইআরডির পর্যালোচনার পর জানা যাবে বলে ইআরডি’র একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
[৯] বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘যদিও আইএসডিবি দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিচ্ছে, তবে শর্তাবলী থেকে বোঝা যায় যে ঋণগুলো বাণিজ্যিক ঋণের মতো হবে, মিড-সোয়াপের সঙ্গে বিভিন্ন চার্জ যুক্ত থাকবে। তিনি বলেন, ডলার সংকটের এ সময়ে বিদেশি উৎস বাড়ানোর জন্য এ ধরনের ঋণ নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে পুরো ঋণই নিতেই হবে এমন শর্ত না রেখে আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ঋণের পরিমাণ নির্ধারণ যাতে করা যায় সে সুযোগ রাখতে হবে, বলেন তিনি।
[১০] দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায় এবং বাণিজ্যিক সুফল আসবে এমন প্রকল্পে এ ধরনের ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দেন জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তেল ও গ্যাস সংগ্রহের জন্য আইটিএফসি ঋণ নেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ ২০০৮ সাল থেকে তেল কেনার জন্য আইটিএফসি থেকে ঋণ নিচ্ছে। ২০২৪-২৫ সাল থেকে সরকার গ্যাস ক্রয়ের জন্যও বহুপাক্ষিক ঋণদাতা গোষ্ঠীটি থেকে ঋণ নেওয়া শুরু করেছে।
[১১] আইএসডিবির আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অর্থায়নকারী শাখার প্রস্তাবিত ছয় মাসের মেয়াদ পরিবর্তিত হতে পারে। সংশ্লিষ্ট সরকারি মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সঙ্গে আলোচনার পর যেকোনো সমন্বয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানায় ইআরডি সূত্র।
[১২] ইআরডি কর্মকর্তারা বলেছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য প্রকল্প অর্থায়ন পায়নি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ আইএসডিবি থেকে কোনো ঋণ নেয়নি।
[১৩] বাংলাদেশ ২০২০-২১ অর্থবছরে মাত্র ৩৬.৪ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭২ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিল। এর আগের দুই অর্থবছরে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক এই উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা থেকে কোনো ঋণ নেওয়া হয়নি।
[১৪] একজন ইআরডি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আইএসডিবি প্রাথমিকভাবে ইআরডির মাধ্যমে সংগ্রহ করা ওসিআর (অর্ডিনারি ক্যাপিটাল রিসোর্সেস) ঋণের প্রস্তাব করেছে। শর্তাবলি পর্যালোচনার পর সরকার এ ঋণদাতার কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করবে কি না এবং করলে পরিমাণ কত হবে তা নির্ধারণ করবে।
[১৩] পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ এ ঋণের মেয়াদ ২০ বছর। সুদের হার হবে পাঁচ বছরের মিড-সোয়াপ রেটসহ ১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ৯ শতাংশ। ঋণের পরিষেবা চার্জ প্রতি বছর দেড় শতাংশের বেশি হবে না।
[১৪] ইআরডি সূত্র অনুসারে, আইএসডিবি আগামী তিন বছরে তেল কেনার জন্য ১.৯ বিলিয়ন ডলার এবং এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) কেনার জন্য আইটিএফসি থেকে অবশিষ্ট ১.৩ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। ঋণের জন্য সংস্থাটি ছয় মাসের এসওএফআরের সঙ্গে ছয় মাস ১ দশমিক ৮ শতাংশ হারে সুদ নেবে। এছাড়া একটি পরিষেবা চার্জের পাশাপাশি শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ প্রশাসনিক চার্জও দিতে হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জ্বালানি বিভাগের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, আইটিএফসি’র সিইও ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে আসবেন বলে আশা করা হচ্ছে। তার সফরের সময় ঋণ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হবে।
[১৫] জ্বালানি তেল ও এলএনজিসহ দেশের জ্বালানি আমদানির ব্যয় ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার ছিল। আগামী জুনে শেষ হতে যাওয়া চলতি অর্থবছরেও একই পরিমাণ বিল হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা পূর্বাভাস দিয়ে বলছেন, বাংলাদেশ এভাবে আমদানির ওপর নির্ভর করতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে জ্বালানি বিল দ্বিগুণ হতে পারে।
[১৬] তারা বলছেন, চলতি বছরের মার্চ থেকে জ্বালানি তেলের জন্য স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণের ব্যবস্থা চালু করার কথা ভাবছে সরকার। উচ্চ সুদে এই ঋণ ব্যবহার করে জ্বালানি তেল আমদানি করার পর এর দামও স্বয়ংক্রিয় মূল্য পদ্ধতির আওতায় বাড়বে। অর্থাৎ উচ্চ মূল্য এবং পুঞ্জীভূত সুদ ভোক্তাদের ওপর চাপবে।
[১৭] গত বছর সরকার জ্বালানি তেল আমদানির জন্য আইটিএফসি থেকে ১.৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়ার জন্য চুক্তি করেছিল। এর মধ্যে ৮০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে বিপিসি (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন)। বাকি ৬০০ মিলিয়ন ডলার আগামী জুনের মধ্যে পাওয়ার কথা রয়েছে। ডলার সংকটের কারণে এ ঋণের কিস্তি সময়মতো পরিশোধ করা যাচ্ছে না। পরে আইটিএফসি থেকে সময় বাড়িয়ে নেওয়া হয়। ২০০৮ সালে চালু হওয়ার পর থেকে আইটিএফসি বাংলাদেশের জন্য প্রায় সাড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য সহায়তা প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। ব্যাংকসহ বেসরকারি খাত আইটিএফসি থেকে বাণিজ্যিক আর্থিক সহায়তা নেয়।