
রাজশাহীতে সামান্য জ্বরেই কাহিল হচ্ছে শিশুরা

রাজশাহী প্রতিনিধি : [১] সম্প্রতি রাজশাহীতে শিশু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে শিশুদের জন্য নির্ধারিত শয্যার বিপরীতে তিনগুণ বেশি রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। এ ছাড়া বেসরকারি হাসপাতাল এবং চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারেও শিশু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দেশের অনেক অ্যান্টিবায়োটিক রোগীদের ওপর কাজ করছে না। তা ছাড়া সামান্য জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত শিশুদের প্রয়োজন পড়ছে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের (আইসিইউ)। এমন পরিস্থিতিতে অভিভাবকদের পাশাপাশি চিকিৎসকরাও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
[২] রাজশাহীতে গত ১৩ ও ১৭ ফেব্রুয়ারি শিশু দুই বোন মারা যাওয়ার পর তাদের মৃত্যুর কারণ এখন পর্যন্ত নির্ণয় করতে পারেনি স্বাস্থ্য বিভাগ। বাবা-মাসহ মৃত শিশুদের রোগের নমুনা সংগ্রহ করা হলেও রোগ নির্ণয়ে এখন ১০ থেকে ১৫ দিন লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এমন অবস্থায় নতুন ভাইরাস নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন তারা। এজন্য চিকিৎসকদের সতর্কতার সঙ্গে রোগীদের পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়া কথা বলা হয়েছে। [৩] রামেক হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের চিকিৎসকদের দেওয়া তথ্যমতে, শীত বা গ্রীষ্মে রামেক হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে রোগীর চাপ বেশি থাকে। তবে শীতের সময় শ্বাসকষ্টে প্রদাহ, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, হাঁপানি, ডায়রিয়া ও জন্ডিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এ বছরও একই চিত্র। হাসপাতালে নির্ধারিত তিনটি শিশু ওয়ার্ডে ১৫০টি শয্যা রয়েছে। যার বিপরীতে ভর্তি শিশু রোগী প্রায় ৫০০।
[৪] গত বৃহস্পতিবার সরেজমিন রামেক হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, ১০ নং শিশু ওয়ার্ডে ৩৪টি শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি আছে ২০০ জন। এ ছাড়া ১ হাজার ২০০ শয্যার এই হাসপাতালটির ৬০টি ওয়ার্ডে বৃহস্পতিবার রোগী ভর্তি ছিল মোট ২ হাজার ৭৮১ জন। প্রতিদিন গড়ে যে সংখ্যক রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছে, তার দ্বিগুণ আবার এই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে।
[৫] রামেক হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. শাহিদা ইয়াসমিন বলেন, নতুন নতুন ভাইরাস তো আসতেই পারে। করোনা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এ ছাড়া পুরোনো ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া তার রূপ পরিবর্তন করছে। নিউমোনিয়াসহ শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ ও হেপাটাইটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনার আগে এমন রোগীর সংখ্যা একদিকে যেমন কম ছিল, তেমনি এসব রোগীর সিভিআর বা গুরুতর হওয়ার হারও কম ছিল। তবে এখন সামান্য জ্বরে আক্রান্ত শিশুদেরও আইসিইউ লাগছে। ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া তার রূপ পাল্টেছে বলে মনে হচ্ছে। [৬] অ্যান্টিবায়োটিক তার কার্যকারিতা হারাচ্ছে উল্লেখ করে এই চিকিৎসক বলেন,অ্যান্টিবায়োটিক একটা বড় কারণ। এসব ওষুধ ড্রাগ রেজিটেন্স হয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু অ্যান্টিবায়োটিক একেবারেই কাজ করছে না। একটা অ্যান্টিবায়োটিক যখন ড্রাগ রেজিটেন্স হয়ে পড়ছে, তখন হায়ার অ্যান্টিবায়োটিকে যেতে হচ্ছে। আমাদের হাতে আর কতটিইবা অ্যান্টিবায়োটিক আছে। দেশে এর সংখ্যাও সীমিত। এসব আমাদের মতো চিকিৎসকদের ভাবিয়ে তুলছে।
[৭] রামেকের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. খন্দকার মো. ফয়সল আলম বলেন, বর্তমানে শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, ডায়রিয়া ও জন্ডিসের (হেপাটাইটিস-এ) মতো রোগের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আক্রান্তের হার বৃদ্ধি পেলেও মৃত্যুহার কম। তবে শিশু দুই বোন মারা যাওয়ার পর তাদের মৃত্যুর কারণ এখনও শনাক্ত করা যায়নি। তাদের মৃত্যুর কারণ যদি ভাইরাস হয়ে থাকে, তবে তা চিহ্নিত করাটা জরুরি।
[৮] পুরোনো ভাইরাসে তাদের মারা যাওয়ার কারণ হতে পারে না। তা ছাড়া এটা যদি ছোঁয়াচে হয়, তবে তা হবে আরও দুশ্চিন্তার কারণ। একেকটি ভাইরাসের জন্য একেক ধরনের স্যাম্পল পরীক্ষা করতে হয়। পরীক্ষায় বেশিরভাগ টাইফয়েড ধরা পড়ছে। নোবেল (নতুন বা বিশেষ) ভাইরাস চিহ্নিতের জন্য দেশের মধ্যে তেমন কোনো পরীক্ষা ব্যবস্থা নেই। এসব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি কাজ করে। আমাদের আইইডিসিআর এটা নিয়ে ব্যবস্থা নিয়েছে।
[৯] রোগের প্রধান কারণ পানি ও বাতাস বলে জানান এই চিকিৎসক। তিনি বলেন, নিউমোনিয়া বাতাস থেকে বিস্তার লাভ করে। জন্ডিস ও টাইফয়েড পানিবাহিত রোগ। ওয়াসার সুয়ারেজের পানি লিক করছে কি না তা ছাড়া বোতলজাত পানি নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। আমরা ওয়াসাকে বিষয়গুলো দেখতে অনুরোধ করেছি।
[১০] রামেকের প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ডা. নওশাদ আলী বলেন, রোগের প্যাটার্ন বদলাচ্ছে। আক্রান্তকারী জীবাণুও পরিবর্তন হচ্ছে। করোনা, ডেঙ্গু ও নিপা- এগুলো ভাইরাসজনিত রোগ। সম্প্রতি দুই শিশু মারা গেছে। আমরা ভেবেছিলাম তারা নিপা ভাইরাসে মারা গেছে। পরে দেখা গেল নিপা নয়।এটা আমাদের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি করেছে। একটা রোগের প্যাটার্ন জানা থাকলে আমাদের চিকিৎসা দিতে সুবিধা হয়। এখন যেকোনো জ্বর হলেই সতর্ক হতে হবে। এখন তো সামান্য জ্বর-সর্দি বা খিঁচুনি নিয়ে শিশুরা ভর্তি হলেও আমরা চিকিৎসকরাও ভয় পেয়ে যাচ্ছি। সতর্কতার সঙ্গে রোগীকে চিকিৎসা দিচ্ছি। এমন কেস হতে থাকলে আমাদের পৃথক প্রস্তুতি নিতেই হবে। এর জন্য অবশ্যই পৃথক গবেষণা করতে হবে।
