বাংলায় ইউরোপীয় বণিকগণের শোষণ ও লুটতরাজ
গরীব নেওয়াজ
এর আগে মধ্যযুগে আগ্রা-দিল্লির শাসন-শোষণ সম্পর্কে লিখেছি। এবার পর্তুগিজ, ফরাসি ও ওলন্দাজদের সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। [ক] পর্তুগিজ : বাংলায় আলাউদ্দিন হুসেন শাহের (১৪৯৩–১৫১৯ খ্রি.) রাজত্বকালেই প্রথমে পর্তুগিজরা আসে ব্যবসা-বাণিজ্য করার উদ্দেশে। কিন্তু দেশের পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে না হওয়ায় এবং তাদের দস্যুবৃত্তি ও লুটতরাজ অত্যাচারের জন্য নসরৎ শাহ্ (১৫১৯-১৫৩২ খ্রি.)-এর রাজত্বকালে তাঁর আদেশে তাদের অনেককে হত্যা করা হলে তারা সুবিধা করতে পারেনি। কিন্তু বাংলায় হুসেন শাহী বংশের শেষ সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ্ (১৫৩৩-১৫৩৮ খ্রি.) শের শাহের আক্রমণ হতে দেশকে রক্ষা করার জন্য পর্তুগিজদের নিকট হতে সামরিক সাহায্য পাওয়ার আশায় তাদের সাথে সম্পর্ক উন্নত করলেন। চট্টগ্রাম ও সাতগাঁওয়ে পর্তুগিজদের দুর্গ ও কারখানা প্রতিষ্ঠিত হলো। বঙ্গের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে তাদের প্রভাব বিস্তৃত হতে থাকে। তবে মাহমুদ শাহ্ শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাননি। শেরশাহ্ গৌড় (বাংলার রাজধানী) দখল করে নেন। পর্তুগিজরা ধীরে-ধীরে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। তারা প্রচলিত নীতি ভঙ্গ করে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের নিকট হতে শুল্ক আদায় শুরু করে। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান দাউদ খান কররানিকে পরাজিত ও হত্যা করে বাংলা দখল করে বাংলার?ও সম্রাট হন।
১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজদের নেতা পেড্রো স্ট্রাভার সম্রাট আকবরের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে ব্যবহারে সন্তুষ্ট করে এদেশে ব্যবসা বাণিজ্য করার বিশেষ সুবিধা আদায় করেন। সম্রাট আকবরের অনুমতিক্রমে তারা হুগলি নদীর তীরে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে। এ সময় থেকে তারা স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বণিকদের নিকট হতে জোর করে শুল্ক আদায় করতে আরম্ভ করে। পর্তুগিজ পাদরিরা এদেশে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। তারা হিন্দু-মুসলিম শিশুদের লুণ্ঠন করে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করতে থাকে। ইসলাম ধর্ম ও হজরত মুহাম্মদ (দ.) সম্পর্কে তারা কুৎসা রটনা করে বেড়াত। পর্তুগিজরা দাস ব্যবসা করত। তারা বাংলার নর-নারীকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে বাজারে দাস হিসেবে বিক্রি করত। তাদের অত্যাচারে হুগলি নদীর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো জনশূন্য হয়ে পড়ে। তাদের শক্তি ও অত্যাচার এতদূর বৃদ্ধি পেল যে, ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াল।
বাংলার জলপথে পর্তুগিজরা দস্যুবৃত্তিও শুরু করে। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জলদস্যুদের ভয়াবহ উপদ্রব মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। পর্তুগিজদের মধ্যে একশ্রেণির লোক চট্টগ্রাম, সাতগাঁও ও হুগলিতে ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত থাকল আর এক শ্রেণির লোক আরকানী অর্থাৎ মগ বলে পরিচিত দস্যুদের সাথে মিলিত হয়ে বাংলার ভাঁটি অঞ্চলে লুটতরাজ করে বেড়াত। বাংলায় পর্তুগিজ দস্যুদের ফিরিঙ্গি ও হার্মাদ বলা হতো। সম্রাট আকবরের পর সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে মগ ফিরঙ্গি দস্যুরা ঢাকার উপকণ্ঠে যাত্রাপুর ও বিক্রমপুর অঞ্চলে লুটতরাজ করতে আসতো। এরা চট্টগ্রাম হতে খুলনা, সন্দ্বীপ, বাঁকলা ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের উপকূল এলাকায় ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে লুটতরাজ চালাত। মগ ও ফিরিঙ্গিরা নৌশক্তিতে খুব পারদর্শী ছিল। তাদের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত অনেক জাহাজ ছিল। তাদের নিষ্ঠুর কার্যকলাপে সমৃদ্ধিশালী দ্বীপাঞ্চল ক্রমান্বয়ে জনপদহীন হয়ে পড়ে। ফিরিঙ্গিরা ধৃত বন্দিদের সাথে নিষ্ঠুর ব্যবহার করত এবং ওলন্দাজ, ইংরেজ ও ফরাসি বণিকদের নিকট উচ্চদামে বিক্রয় করত। শিহাবুদ্দিন তালিশের বর্ণনায় উল্লেখ আছে যে, বাংলার বুকে দীর্ঘদিন ধরে ফিরিঙ্গি দস্যুদের লুটপাটের ফলে উপকূল অঞ্চল জনশূন্য হয়ে পড়ে। তাদের নিষ্ঠুর স্বভাব, লোভ-লালসা ও দস্যুবৃত্তি এদেশের মানুষের মনে গভীর ঘৃণার সঞ্চার করেছিল।
সুবেদার শায়েস্তা খাঁর আমলে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। অন্যদিকে পর্তুগিজদের বাণিজ্য বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও প্রসারিত হয়েছিল। ষোড়শ শতকের মধ্যভাগে বাংলার অধিকাংশ ব্যবসা-বাণিজ্য পর্তুগিজরাই নিয়ন্ত্রণ করত। ১৫৮৩ হতে ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার রপ্তানি বাণিজ্য প্রায় সবটাই পর্তুগিজদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হতো। বাংলা অঞ্চল থেকে তারা চাল, তেল, ঘি, সুতা, কাপড় এবং কারুকার্য-খচিত নানা প্রকার দ্রব্য বিদেশে রপ্তানি করত। এদেশে উৎপন্ন দ্রব্যাদির মূল্য তখন খুব কম ছিল। ফলে এদেশের পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে তারা প্রচুর ধনরত্নের অধিকারী হয়েছিল। বাণিজ্য ক্ষেত্রে পর্তুগিজদের প্রভাব ছিল অপ্রতিহত। হুগলী, সাতগাঁও ও চট্টগ্রাম বন্দর ছাড়াও তারা বঙ্গোপসাগর ও অন্যান্য জলপথে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। বৈদেশিক বাণিজ্য জাহাজ তাদের অনুমতি ছাড়া ওই সমস্ত বাণিজ্য কেন্দ্রে ভিড়তে পারত না। এমনকি পর্তুগিজদের ছাড়পত্র ছাড়া এ অঞ্চলে যেকোনো বাণিজ্য জাহাজ শত্রু জাহাজ বলে চিহ্নিত হতো।
[খ] ফরাসি : ফরাসিরা এদেশে সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখতো। ১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে তারা প্রথমে চন্দননগর অধিকার করে এবং পরে বঙ্গের সুবেদার শায়েস্তা খানের অনুমতিক্রমে কয়েকটি বাণিজ্যিক কুঠি (ফ্যাক্টরি) প্রতিষ্ঠা করে। উল্লেখ্য যে, ওলন্দাজদের বিরোধিতার ফলে বহুদিন পর্যন্ত তারা এখানে কোনো বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করতে পারেনি। পরে তারা ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে নবাবের দরবারে ঘুষ দিয়ে নিজেদের জন্য সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা আদায় করে। ১৬৯২ খ্রিস্টাব্দে ফরাসিরা এখানে বাণিজ্যকুঠি ও অন্যান্য নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করে। এ নির্মাণ কাজে তাদের ২৬ হাজার টাকা ব্যয় হয়। ১৬৯৩ খ্রিস্টাব্দে বার্ষিক এককালীন ৪০ হাজার টাকা এবং শতকরা সাড়ে তিন টাকা কর দেওয়ার শর্তে নবাবের নিকট হতে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় ব্যবসার অনুমতি লাভ করে। ১৭১৮ খ্রিস্টাব্দে তারা বঙ্গে ফরাসি বাণিজ্যিক তৎপরতা বাড়ানোর লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট ফররুখশিয়ারের নিকট আবেদন করে। মুঘল সম্রাট শতকরা আড়াই টাকা শুল্কের বিনিময়ে বঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যায় ব্যবসার সুযোগ সুবিধা দিয়ে একটি ফরমান জারি করেন। এদিকে ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলি খান তাদের একটি পরোয়ানা প্রদান করেন। এজন্য তারা মুঘল সম্রাটকে চল্লিশ হাজার টাকা এবং বঙ্গের নবাবকে ১০ হাজার টাকা কর দিতে স্বীকৃত হন। মুর্শিদকুলি খানের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ফরাসি কোম্পানি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এতদূর সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে যে, তারা ইংরেজদেরকে দুই লক্ষ টাকা পর্যন্ত ধার দিতে হয় সমর্থ হয়।
[গ] ওলন্দাজ : এছাড়াও ওলন্দাজ, দিনেমার এবং আরও কয়েকটি ইউরোপীয় বণিক সম্প্রদায় এদেশে আগমন করে। ওলন্দাজরা ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলি খানকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে পর?ওয়ানা লাভ করে। ১৭০৮ ও ১৭০৯ খ্রিস্টাব্দে ওলন্দাজরা মুঘল সম্রাটের নিকট থেকে ফরমান লাভ করে। এই ফরমান অনুযায়ী তাদেরকে হুগলিতে শতকরা আড়াই টাকা শুল্ক দিতে হতো। ১৭১১ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলি খান ওলন্দাজদের অনুরোধক্রমে তাদের একটি ফরমান প্রদান করেন। ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট জাহান্দার শাহ্ ওলন্দাজদের নিকট থেকে কিছু উপহার পেয়ে তাদের দাবিদাওয়া মেনে একটি নতুন ফরমান জারি করেন। জাহান্দার শাহ্ মৃত্যুবরণ করলে ওলন্দাজদের অনুরোধে নতুন সম্রাট ফররুখশিয়ার পূর্ব ফরমানের সুবিধাসমূহ বহাল রেখে নতুন ফরমান জারি করেন। দিল্লির সম্রাট ও তার সুবেদারদের সন্তুষ্ট রেখে এই সমস্ত বিদেশিরা আমাদেরকে শুধু অর্থনৈতিক দিক দিয়েই পঙ্গু করেনি, নিজেদের আধিপত্য বাড়াতে তারা আমাদের রাজনীতিতেও হস্তক্ষেপ করত। এর মধ্যে ইংরেজরা শেষ পর্যন্ত সবদিক দিয়েই তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে সমর্থ হয়। ইংরেজদের সম্পর্কে আলোচনা করার পূর্বে মারাঠা বর্গীদের সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন। এরপর মারাঠা বর্গীদের লুটতরাজ সম্পর্কে আলোচনা করব। তারপর ইংরেজ-সহ অন্যান্যদের শোষণ সম্পর্কে লিখব। ফেসবুক থেকে