অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহযোগিতা ও অনুকূল পরিবেশ
ড. প্রণব কুমার পান্ডে : ৭ জানুয়ারি ২০২৪Ñ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য সহযোগিতা ও টিমওয়ার্কের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেওয়া হয়। গত পনের বছরে আওয়ামী লীগ সরকার উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। চরম দারিদ্র্যের অবস্থা থেকে অগ্রগতির মানদণ্ডে পরিণত হয়েছে। তাই, অর্থনৈতিক উন্নয়নের উদ্যোগের গতি বজায় রাখার জন্য ব্যক্তি, সরকারি নীতি ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে একটি সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা অপরিহার্য। যেহেতু আমরা পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক পরিবেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছি, এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষা ও উন্নত করতে সহযোগিতা অপরিহার্য। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য রাজনৈতিক ঐক্য জরুরি। সাম্প্রতিক সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দল অংশগ্রহণ না করলেও বিরোধী দলগুলোকে বুঝতে হবে যে, দেশের স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে একসঙ্গে কাজ করার ওপর।
যখন সরকারকে দুর্বল করার জন্য অন্য কোনো কার্যকরী বিকল্প নেই, তখন সকল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে তাদের মতানৈক্য একপাশে রেখে দেশের সর্বোত্তম স্বার্থের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে সহযোগিতা এই সময়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে, বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে ও জনসংখ্যার মঙ্গল উন্নতির জন্য সংস্কার করতে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ তার সম্মিলিত সম্ভাবনাকে উন্মোচন করতে পারে। সমৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধির অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির চারপাশে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এর সকল বাসিন্দাদের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির চাবিকাঠি হলো এর বিভিন্ন খাতের মধ্যে ঐক্য ও সহযোগিতা। সরকার, বাণিজ্যিক কর্পোরেশন, সুশীল সমাজ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সকলেরই দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ফ্র্যাগমেন্টেশন ও মতবিরোধ অগ্রগতিতে বাধা দেয়, কিন্তু ঐক্য, দলগত কাজ স্থিতিশীলতাকে উন্নীত করে, নতুন বৃদ্ধির সুযোগ উন্মুক্ত করে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অনুকূল পরিবেশ প্রদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। নীতি কাঠামো যা উন্মুক্ততা, জবাবদিহিতা ও বৈচিত্র্যের উপর জোর দেয় কোম্পানির ক্ষমতায়ন, বিনিয়োগের প্রচার, টেকসই উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক উন্নয়নের দায়ভার শুধু সরকারের ওপর ন্যস্ত করা উচিত নয়। এতে সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টার প্রয়োজন যাতে সমাজের সকল ক্ষেত্র সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকে ও ভাগ করা লক্ষ্যে অবদান রাখে। বেসরকারি সংস্থাগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও উদ্ভাবনের গুরুত্বপূর্ণ চালক। উদ্যোক্তাকে উৎসাহিত করে, প্রতিযোগিতাকে সমর্থন করে, নৈতিক ব্যবসায়িক পদ্ধতি গ্রহণ করে, তারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করে ও ব্যক্তিদের তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা অর্জনে সক্ষম করে। পাবলিক ও বাণিজ্যিক খাতের মধ্যে সহযোগিতা পদ্ধতিগত অসুবিধা সমাধান, সম্পদ পুলিং, প্রভাব অপ্টিমাইজ করার জন্য অপরিহার্য। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) অবকাঠামোগত উন্নয়নকে উদ্দীপিত করতে পারে, পরিষেবা সরবরাহের উন্নতি করতে পারে ও বাস্তবায়নের সঙ্গে নীতি নির্মাণকে সংযুক্ত করতে পারে।
সুশীল সমাজ জাতির বিবেক হিসাবে কাজ করে ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মূল্যবোধ বজায় রাখার গ্যারান্টি দেওয়ার জন্য একটি প্রহরী হিসাবে কাজ করে। সামাজিক ন্যায়বিচার, পরিবেশগত স্থায়িত্ব, কর্পোরেট দায়িত্বের অগ্রগতির জন্য এনজিও, অ্যাডভোকেসি গ্রুপ ও সম্প্রদায়-ভিত্তিক সংস্থাগুলো অপরিহার্য। সুশীল সমাজের অভিনেতারা কথোপকথনে অংশগ্রহণ করে, সচেতনতা তৈরি করে ও কেউ যাতে বাদ না পড়ে তা নিশ্চিত করার জন্য সম্পদ একত্রিত করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায্য অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে একটি দরকারি মিত্র হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান, দাতা সংস্থা ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া তথ্যের আদান-প্রদান, প্রযুক্তি বিনিময়, আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করতে সক্ষম করে। বাংলাদেশ নতুন বাজারে প্রবেশ করতে পারে, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণ করতে পারে ও বৈশ্বিক সম্পর্ক উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে একীভূত হতে পারে।
দারিদ্র্য, বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তন ও ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সহ উল্লেখযোগ্য উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই অসুবিধাগুলো আলাদাভাবে মোকাবেলা করা খুব জটিল। তাদের প্রয়োজন সাম্প্রদায়িক প্রচেষ্টা, সংহতি ও প্রত্যেকের জন্য একটি উচ্চতর ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য পারস্পরিক উৎসর্গ। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ তার পূর্ণ সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে পারে ও বিশ্বব্যাপী জ্ঞান অর্থনীতিতে সম্ভাবনার সদ্ব্যবহার করতে পারে। মানব পুঁজিতে বিনিয়োগ করে, জীবনব্যাপী শিক্ষাকে উৎসাহিত করে ও উদ্ভাবনের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ যাতে শ্রমবাজারের পরিবর্তিত চাহিদা মেটাতে পারে, উদ্যোক্তাকে উন্নীত করে, একটি উচ্চ প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী গড়ে তুলতে পারে তা নিশ্চিত করতে শিক্ষাবিদ, ব্যবসা ও সরকারকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। উপসংহারে, এটা বলা যেতে পারে যে বাংলাদেশ সম্ভাবনা, অসুবিধা উভয়ই একটি নতুন যুগের দ্বারপ্রান্তে, সরকার, রাজনৈতিক দল ও সকল স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সহযোগিতার গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
দেশের ক্রমাগত অর্থনৈতিক সাফল্য নির্ভর করে রাজনৈতিক মতানৈক্য কাটিয়ে উঠতে পারস্পরিক বোঝাপড়া প্রতিষ্ঠা ও অভিন্ন লক্ষ্যে সহযোগিতা করার ক্ষমতার উপর। সমন্বিত প্রচেষ্টা ও সহযোগিতা ব্যতীত উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়, একটি সমৃদ্ধিশীল জাতির জন্য আমাদের যৌথ লক্ষ্যগুলোকে বাধাগ্রস্ত করে। সকল স্টেকহোল্ডারদের অবশ্যই ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে সাধারণ কল্যাণকে প্রাধান্য দিতে হবে। ফলপ্রসূ আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে হবে, মৌলিক আদর্শ হিসেবে অন্তর্ভুক্তি ও ঐক্য বজায় রাখতে হবে। আমাদের বৈচিত্রময় সমাজের সম্মিলিত জ্ঞান, সম্পদ ও প্রচেষ্টাকে কাজে লাগিয়ে আমরা বাধাগুলো মোকাবেলা করতে পারি। নতুন সম্ভাবনাগুলো আবিষ্কার করতে পারি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন ও সাফল্যের পথ নির্ধারণ করতে পারি। আমাদের সকলের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার, সংযোগ তৈরি করার ও বাংলাদেশের জন্য আরও প্রতিশ্রুতিশীল ভবিষ্যতের পথ প্রস্তুত করার সময় এসেছে।
লেখক: অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : ডেইলি সান