সুন্দরবনের জন্য প্রয়োজন একটি টেকসই উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি
শিব্বির আহমেদ তাশফিক : বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের কাছে পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর মোহনায় গড়ে উঠেছে সুন্দরবন নামে পরিচিত বিশাল বনভূমি। হিমালয় থেকে আসা মিঠা পানি ও বঙ্গোপসাগরের লবণাক্ত পানির সংমিশ্রণের কারণে এই বনের একটি অনন্য বাস্তুতন্ত্র রয়েছে। ডোরাকাটা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, গোলপাতা, জোয়ার ও মৌয়াল যখন আমরা সুন্দরবন সম্পর্কে জানতে পারি তখন মনে পড়ে। বিভিন্ন উদ্ভিদ প্রজাতির সুন্দর সংমিশ্রণ ও বন্যপ্রাণীর সমাবেশ এই বনভূমির আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলে। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভক্তির পর সুন্দরবনের দুই তৃতীয়াংশ বাংলাদেশের ও অবশিষ্ট অংশ ভারতের। ১৮৭৮ সালের ভারতীয় বন আইন সমগ্র অঞ্চল সহ সুন্দরবনকে একটি সংরক্ষিত বন হিসাবে মনোনীত করেছে। যদিও সুন্দরবনের নামের উৎপত্তি অস্পষ্ট, তবে প্রায়শই এই বনে জন্মানো অত্যাশ্চর্য গাছের নাম থেকে এটি এসেছে বলে মনে করা হয়। একাধিক মূল্যায়নে, বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) সুন্দরবনকে বিশ্বের অন্যতম জীববৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা সুন্দরবনের মহান জীববৈচিত্র্যকে এর ভৌগলিক অবস্থান, গঠন প্রক্রিয়ার জন্য দায়ী করেন। বাংলাদেশ বন বিভাগ জানিয়েছে যে এর আয়তন প্রায় ৬,০১,৭০০ হেক্টর বা দেশগুলোর মোট আয়তনের ৪.১৩ শতাংশ ও বনভূমির ৩৮.১২ শতাংশ এর আওতাধীন। ইউনেস্কো ১,৩৯,৭০০ হেক্টর সুন্দরবনের বনাঞ্চলকে মনোনীত করেছে। যার মধ্যে তিনটি প্রাণী অভয়ারণ্য রয়েছে ১৯৯৭ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে।
সুন্দরবন জাতীয় অর্থনীতির পাশাপাশি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি দেশের মোট বনজ সম্পদের একক বৃহত্তম উৎস ও কাঠের উপর নির্ভরশীল শিল্পের কাঁচামালের একটি বড় অংশ প্রদান করে। এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে সুন্দরবনের অবদান বছরে ৫ হাজার টাকার বেশি। সুন্দরবন শুধু নামেই সুন্দর নয়, গাছপালা ও প্রাণীজগতেও রয়েছে চিত্তাকর্ষক কাঠামো। যুগে যুগে দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অবদান রেখে আসছে অসংখ্য জানা-অজানা উদ্ভিদ ও প্রাণী। সুন্দরবনের বুক চিরে বয়ে গেছে ৪০০টি নদী ও ২০০টি খাল। এসব নদী ও খালে প্রায় চারশ প্রজাতির মাছ রয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতির মধ্যে রয়েছে ২০ প্রজাতির চিংড়ি, ৭ প্রজাতির কাঁকড়া, ৬ প্রজাতির ঝিনুক ও অন্যান্য প্রজাতি। সুন্দরবনের প্রতিটি উপাদানেরই অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। সুন্দরী ও গেওয়া কাঠের সুনাম রয়েছে দেশে-বিদেশে। এসব গাছের কাঠ পেন্সিল, ক্রেয়ন, নিউজপ্রিন্ট পেপার, প্রতিদিনের আসবাবপত্র, নৌকা ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। কেওড়া সুন্দরবনের একটি উল্লেখযোগ্য গাছ। লবণ সহিষ্ণু এই গাছ উপকূলীয় মাটির ক্ষয় রোধ করে মাটিকে শক্তি ও উর্বরতা দেয়। এ ছাড়া সুন্দরবনের মৎস্য চাষ এলাকার মানুষের আয়ের একটি প্রধান উৎস, যেখান থেকে কোনো প্রকার বিনিয়োগ ছাড়াই প্রচুর অর্থ আয় করা সম্ভব। মৌয়ালরা সুন্দরবন থেকে প্রচুর মধু ও মোম সংগ্রহ করে। যা দেশের মধুর চাহিদা পূরণের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে। সুন্দরবনকে প্রায়ই বাংলাদেশের ‘ফুসফুস’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। কারণ এটি বাংলাদেশের একটি বিশাল অক্সিজেন কারখানা হিসাবে কাজ করে।
২০১৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যাতে বলা হয়েছে যে ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় সুন্দরবন দক্ষিণ-পশ্চিমের দেশগুলোতে প্রায় ১০০,০০০ কোটি টাকার সম্পদ সংরক্ষণ করেছে। গবেষকরা অনুমান করেন যে সুন্দরবনের অস্তিত্ব না থাকলে ক্ষয়ক্ষতি উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি হতো। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ১৯৬০ সাল থেকে আম্ফান সবচেয়ে দীর্ঘ সময়কাল ও বৃহত্তম বিচ্ছুরণ সহ ঘূর্ণিঝড়। বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম ও একটি বিশাল অঞ্চল জুড়ে থাকা এই ঘূর্ণিঝড়টি ১৯৯১, ২০০৭-এর সিডর বা ২০০৯ সালের আইলা ঘূর্ণিঝড়ের তুলনায় কম ক্ষয়ক্ষতি, কম লোক মারা যাওয়ার কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো সুন্দরবন। আম্পান বাংলাদেশের সাতক্ষীরায় ১৫১ কি.মি. গতিবেগে আঘাত হানে কিন্তু তার আগেই সুন্দরবনে ঝড়ের গতি অনেকটা কমে যায়। ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে থাকা জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ১৫ থেকে ১৮ ফুট হওয়ার কথা থাকলেও সুন্দরবনের কারণে উপকূলে আঘাত হানলে তা ১০ থেকে ১২ ফুটে নেমে আসবে। ফলে উপকূলীয় মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমেছে। এর মধ্যে রয়েছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নদীর কাজ। নদীর জল দূষণের বর্তমান কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো সুন্দরবনের আশেপাশের নদীগুলেতো কয়লা ও তেলের জাহাজের যাতায়াত। তাছাড়া চলমান রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে সুন্দরবন শেষ পর্যন্ত বিপদে পড়তে পারে। কারণ কয়লা পরিবহনে নদী ব্যবহার করতে হবে। আর কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত কাঁচামালগুলোর মধ্যে একটি।
বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় বর্জ্য অথবা গরম পানি নদীর পানিকে দূষিত করতে পারে ও নদীর পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে। আমরা প্রতিনিয়ত সুন্দরবন ধ্বংস করে চলেছি। কখনো উন্নয়নের স্বার্থে আবার কখনো বাছাই করা কিছু লোকের স্বার্থে। নির্বিচারে বন উজাড় ও বন্যপ্রাণী নিধনের কারণে সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র ক্রমশ অরক্ষিত হয়ে উঠছে। পূর্ববর্তী ৩৭ বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদী ভাঙ্গন, অননুমোদিত বসতি ও অনিয়ন্ত্রিত কাঠ কাটার ফলে সুন্দরবনের এলাকা ১৪০ বর্গ কিলোমিটার সংকুচিত হয়েছে। সুন্দরী গাছ, সৌন্দর্যের প্রতিনিধিত্বকারী, মোটামুটি ২৮.৭৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ২০০২ সালে সুন্দরবনে তেল দূষণের বিষয়ে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে একটি স্টাডজ পরিচালিত হয়েছিলো। গবেষণা নথি অনুসারে, স্টাডজ তেল দূষণ থেকে সুন্দরবনের মারাত্মক ক্ষতি রোধ করতে প্রিমিয়াম সরঞ্জাম ও সরবরাহ সংগ্রহের পরামর্শ দিয়েছে। তবে আঠারো বছর পেরিয়ে গেলেও সেই প্রস্তাব বাস্তবায়ন হয়নি। জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) বলেছে, ‘সুন্দরবনই পৃথিবীর একমাত্র শ্বাসপ্রশ্বাসের বন, যেখানে পলি পড়ে নতুন জমি তৈরি হচ্ছে।’ এই এলাকায়, শ্বাস কাঠ জৈবভাবে বেড়েছে। অন্যান্য এলাকা থেকে যেসব প্রাণী সুন্দরবনে চলে আসছে তাদের মধ্যে হরিণ, সাপ ও বাঘ অন্যতম।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ইউনেস্কোর দ্বারা সুন্দরবনের জন্য দশটি বিপদ চিহ্নিত করা হয়েছিলো। কিছু বিষয়ের মধ্যে রয়েছে বেআইনি অভিযান, দূষণ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও পশুসম্পদ নদী ড্রেজিং। ইউনেস্কোর উত্থাপিত উদ্বেগগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে সুন্দরবনের সুরক্ষার জন্য আমাদের অবশ্যই একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ কর্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে হবে। সাম্প্রতিক আইপিসিসি মূল্যায়ন অনুসারে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ তার খাদ্য উৎপাদনের ৩০ শতাংশ ও ভূমির ১৭ শতাংশ হারাবে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল ও সেখানে বসবাসকারী বাসিন্দারা তাই সবচেয়ে বেশি নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের নেতিবাচক প্রভাবে বাংলাদেশ ক্রমাগত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও উত্তরের নদীতে মিঠা পানির প্রবাহ কমে যাওয়া দুটি বিপদ। সামুদ্রিক পানি প্রবেশের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মাটি ও নদী এখন লবণাক্ত হয়ে গেছে। এ ধরনের বিপর্যয় রোধ করতে হলে আমাদের সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হবে। দেশের স্বার্থে সুন্দরবনের টেকসই ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ অপরিহার্য। লেখক: শিক্ষক, লেখক ও গবেষক, বুয়েট। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : ডেইলি অবজার্ভার