মানুষের হাতে অনেক টাকা আছেÑ আসলেই কি!
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
মানুষের হাতে অনেক টাকা!? মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হলেই মনে হয় এমনটাই বলতে হয়। নতুন সরকার গঠনের পর থেকেই আমি সরকারের মধ্যে একটা তোড়জোর দেখছিলাম, প্রচেষ্টা দেখছিলাম। বিভিন্ন উদ্যোগ দেখছিলাম যে, জিনিস পত্রের দাম কমাতে হবে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির যে নম্বর ওয়ান এজেন্ডা, সেটা নানা সময়ে আমাদের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা বলেছেন, সংসদ সদস্যরা বলেছেন। খোদ সরকার প্রধানও বলেছেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এই কথাগুলো বলেছেন যে বিএনপি এখন কোনো এজেন্ডা নয়, এখন এজেন্ডা হলো তাদের জন্য দ্রব্যমূল্য। অমরা যদি নতুন প্রতিমন্ত্রীর দিকে তাকাই তিনিও কিন্তু অনেক কথা বলেছেন। অনেক উদ্যোগও নিয়েছেন আমরা দেখতে পেয়েছি। কিন্তু অবস্থা ভেদে মনে হচ্ছে কিছুটা হলেও রণে ভঙ্গ দিয়েছে সরকার। সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, আগে বাজারে টাকা দিলেও পণ্য পাওয়া যেতো না, কিন্তু এখন আর সেই সমস্যা নেই। এখন মানুষের হাতে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি টাকা আছে। এ কথাও বলছেন যে, ১৭ কোটি মানুষকে আমদানি করে খাওয়ানো যাবে না, …নির্ভরতার কথাও ভাবতে হবে। কিন্তু বাজারে গেলে পণ্যের অভাব হয় না, মানুষের কাছে প্রচুর টাকা আছেÑ এগুলো কিন্তু খুবই অসংবেদনশীল কথা। কারণ হলো অমরা জানি করোনার পর থেকে বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থাপনায় কী চলছে। বিশেষ করে কর্মক্ষেত্রে মানুষের নির্ধারিত আয় কমে গেছে।
নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত্য খুবই জটিলতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। আমি তো আমাকে দিয়েই বুঝতে পারছি এবং আয় বাড়েনি, রোজগার বাড়েনি। কিন্তু খরচ বেড়ে গেছে। শুধু খরচ বাজারে বাড়েনি, লেখাপড়ার খরচ বেড়েছে, চিকিৎসার খরচ বেড়েছে, প্রতিটি স্তরে মানুষের জীবনে খরচ বেড়েছে। তখন এ ধরনের কথা মানুষ কীভাবে নেয় সেটা একটা চিন্তার ব্যাপার অসলে। এই মন্ত্রণালয়ের আগের মন্ত্রী ছিলেন টিপু মুন্সী। তিনি নানা সময়ে নানা ধরনের কথা বলতেন, সেটা নিয়ে নানা অলোচনা হতো। আমাদের হয়তো মনে আছে সিন্ডিকেটকে ধরলে বাজার অস্থির হয়ে যাবে, সরকার বেকায়দায় পরে যাবে। অরেকবার বলে ফেলেছিলেন, বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ৪ কোটি মানুষ নাকি ইউরোপীয় স্ট্যান্ডর্ডের জীবন জাপন করে। এর বাইরে তিনি ব্যবসায়ীদের পক্ষে-বিপক্ষে নানা ধরনের মন্তব্য করে অলোচনায় ছিলেন। কিন্তু যেটা ঘটবার অর্থাৎ বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমবার লক্ষণ আমরা কখনো দেখিনি। এবার একটা প্রত্যাশা ছিলো যে নির্বাচনের পরে সরকার হয়তো খুব আটঘাট করে নামবে। কিন্তু সেটাও মনে হচ্ছে সম্ভব হচ্ছে না।
এখন নতুন প্রতিমন্ত্রী বলছেন, মানুষের হাতে বেশি টাকা হয়ে গেছে। চিনি, খেজুরসহ রমজানের অপরিহার্য পণ্যের দাম নিয়ে মানুষকে কোনো অশ্বাস দিতে না পেরে এখন ভিন্ন কথা কি বলছেন বাণিজ্যপ্রতিমন্ত্রী? নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে একের পর এক বৈঠকে যখন কোনো সুফল মিলছে না তখন বাণিজ্যপ্রতিমন্ত্রী বৈঠক করেছিলেন কাদের সাথে রাজধানীর পাইকারী মোকাম মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীদের সাথে। সেখানে ব্যবসায়ীরা তাকে পেয়ে বসে বেগতিক অবস্থায় পরে পরে ব্যবসায়ীদের দাবি মেনে নিতে হয়েছিল তাকে এবং এটাই বাস্তবতা। দাম নিয়ন্ত্রণের নামে নিত্যপণ্যের দোকানে অভিযান চালানো হবে না এই মর্মে ব্যবসায়ীদের অসস্ত করতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের। আমি অনেকদিন থেকেই বলছি যে বাজারে আমদানিকারক, পাইকারী এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটা মজবুত ঐক্য আছে অস্থিরতা সৃষ্টির পক্ষে এবং এই কথাগুলো এখন সরকারের দিক থেকেও উচ্চারিত হচ্ছে। এদিকে ব্যবসায়িক প্রতিনিধিরা যখন মন্ত্রী-এমপি হন তখন তাদের প্রতি স্বাভাবিকভাবে একটা সহানুভূতি থাকে এবং তারা সবাই মিলে ক্ষমতা কাঠামোকে যখন নিয়ন্ত্রণ করে পরে দেখা যায় স্বাভাবিকভাবে আর কিছু করা যায় না। মন্ত্রী বা সরকারের লোকজন বলে বাজারে সরবরাহে ঘাটতি নেই। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন রমজানে বাজার ঠিক থাকবে। কিন্তু এসব অসংবেদনশীল কথা মন্ত্রী হলে বা প্রতিমন্ত্রী হলে কি বলতে হয়? হয়তো হয়। মন্ত্রী হওয়ার আগেও বলেন না, মন্ত্রীত্ব চলে যাবার পরও বলেন না।
এখন সরবরাহের প্রসঙ্গে আসি। সরবরাহের সঙ্গে দামের কি আসলেই কোনো সম্পর্ক তৈরি করা যায়? প্রধানমন্ত্রী মজুতদারের কথা বলেছেন এবং তাদের গণধোলাই দেওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেছেন। বাংলাদেশে দ্রুত দাম বাড়ে এবং সেই দাম কমলেও আর কমে না। একটা উছিলা তো সবসময়ই আছে আন্তর্জাতিক বাজার, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, করোনা মহামারি। কিন্তু করোনার অগেই বাজার অস্থির ছিলো এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দাম বাড়লেও পরবর্তী সময়ে যখন দাম কমেছে বাংলাদেশে কিন্তু আর দাম কমেনি। এর কারণ হলো আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনায় কোথাও না কোথাও একটা ত্রুটি আছে। সরকার জ্বালানি তেলের দাম কমায় না, এটি সরকার এককভাবে আমদানি করে। বিশ্ব বাজারে কমলেও কমায় না প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু কমায় না। এটা একটা বড় কারণ এবং বাজারের ক্ষেত্রে সরকার যেটা বলে যে বাজার অর্থনীতি অর্থাৎ ব্যবসায়ীরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।
বাজারের সিস্টেমের উপরে এটা ওঠা নামা করে। যেহেতু এটা প্রাইভেট সেক্টর তাই এটা হয়। প্রশ্ন হলো সরকার বাজার অর্থনীতির উপর জ্বালানি তেলটাকে ছেড়ে দিচ্ছে না কেন? এটাকে কেন নিজের হাতে রেখেছে? বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের মতো এমন একটা অদক্ষ এবং দুর্নীতিগ্রস্থ প্রতিষ্ঠানকে কেন সরকারকে পাহারা দিতে হচ্ছে এটি কিন্তু একটা বড় জিজ্ঞাসা। রাজস্ব আদায়ের জন্য সব থেকে ভালো জায়গা হলো জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে মানুষের পকেট থেকে টাকা নেওয়া এবং সরকার সেই কাজটাই বারবার করে যাচ্ছে। রাজস্ব এবং মুদ্রানীতিÑ উভয় ক্ষেত্রে যথাযথ নীতিগত কৌশল কাজ করছে বলে মনে হয় না এবং পদক্ষেপের ঘাটতি আছে। জ্বালানি তেলের দাম যদি কমানো হয় তাহলে তার একটা প্রভাব বাজারে পড়বেই। কারণ বিশ্ববাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে। পণ্য উৎপাদন, পণ্য বিপণন এবং পণ্য পরিবহন তিন ক্ষেএেই প্রভাব পড়বে। কিন্তু সরকার কি সেই পথে হাঁটবেই। সরকার যদি সেই পথে না হাঁটে এবং রাস্তায় রাস্তায় চাঁদাবাজির কথাটাও অনেকে বলে এই সবই সত্য এইগুলো যদি বন্ধ করা না যায়, তাহলে জ্বালানি তেলের দামের মতোই থাকবে জিনিসপত্রের দাম।
পরিচিতি : সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার ফেসবুক পেজের ভিডিও কন্টেন্ট থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন লাবিব হোসেন