বাংলাদেশ কীভাবে জ্বালানি নিরাপত্তা বাড়াতে পারে?
ড. ইজাজ হোসেন : বাংলাদেশ করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ধাক্কা থেকে পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। কারণ এটি এখনও তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটি ধীর। কিন্তু ক্রমাগত নিষ্কাশনের সম্মুখীন হচ্ছে। টাকার অবমূল্যায়ন বন্ধ করতে অক্ষম। আমদানি করা জ্বালানির ওপর তাদের অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার কারণে এই পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতগুলো খারাপভাবে প্রভাবিত হয়েছে। নীতিনির্ধারকরা বুঝতে পেরেছিলেন যে জ্বালানি আমদানির উপর এই ক্রমবর্ধমান নির্ভরতার জন্য বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজনীয়তা শীঘ্রই টেকসই হয়ে উঠবে। বিশেষজ্ঞরা তখন উল্লেখ করেছিলেন যে এই পরিস্থিতি মূলত দুটি ক্ষেত্রকে অবহেলার ফল: গ্যাস অনুসন্ধান ও নবায়নযোগ্য শক্তি। তীব্র উপলব্ধি যে দেশটি তার জ্বালানি আমদানির জন্য অর্থ প্রদান করতে সক্ষম হবে না তা কর্তৃপক্ষ ও নীতিনির্ধারকদের বর্ধিত গ্যাস অনুসন্ধান ঘোষণা করতে ছাদের সৌর প্যানেল, সোলার পার্কগুলোকে উৎসাহিত করতে পরিচালিত করেছিলো।
গত ২০ বছরে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন কোনো উল্লেখযোগ্য মজুদ ছাড়াই তিনগুণ বেড়েছে। কোনো বড় আবিষ্কার সম্ভব হয়নি এই বিশ্বাসে অনুসন্ধানকে চরমভাবে উপেক্ষা করা হয়েছিলো ও সরবরাহের ঘাটতি সহজে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা যেতে পারে। গত দশকে অস্বাভাবিকভাবে কম এলএনজির দাম তাদের উৎসাহিত করেছিলো। যারা এই ধারণাটি প্রচার করেছিলো যে গ্যাস অনুসন্ধানে বিনিয়োগের চেয়ে এলএনজি আমদানি করা সস্তা। এলএনজি আমদানির দৃঢ় প্রবক্তারা উদাহরণ হিসেবে জাপান ও কোরিয়াকে উল্লেখ করেছেন। গার্হস্থ্য প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ ২,৬৬৩ এমএমসিএফডি-এ পৌঁছেছিলো। কিন্তু পরের বছর তা কমতে শুরু করে প্রায় ২,২৫০ এমএমসিএফডি-এ পৌঁছে। এইভাবে, গত ছয় বছরে প্রায় ৪০০ এমএমসিএফডি উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। এই হারে ২০৩০ সালের মধ্যে উৎপাদন বিপজ্জনকভাবে নিম্ন স্তরে পৌঁছে যাবে ও দৈনিক জাতীয় চাহিদা মেটাতে এলএনজি আমদানির বোঝা ডলারের রিজার্ভ, বিনিময় হার উভয়কেই মারাত্মকভাবে চাপ দেবে।
অ্যালার্ম উত্থাপিত হওয়ার পর থেকে দুই বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে ও পূর্বে প্রতিশ্রুত সমস্ত কার্যক্রম এখনও ফল দেয়নি। তবে গ্যাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে কিছু প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। পেট্রোবাংলা ২০২৬ সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ ও ২০২৮ সালের মধ্যে মোট ১০০টি কূপ খননের একটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। পরিকল্পনাটি পর্যাপ্ত অর্থায়ন ও প্রতিবন্ধকতা দূর করার প্রতিশ্রুতি দ্বারা সমর্থন করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত ভোলা গ্যাসক্ষেত্রে নতুন করে নজর দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে অফশোর ব্লকের টেন্ডারও করা হচ্ছে। এখন আমরা অপেক্ষা করছি, দেখছি কতোটা গুরুত্ব ও আন্তরিকতার সঙ্গে ড্রিলিং পরিকল্পনাটি কার্যকর করা হয়। অন্য দীর্ঘ অবহেলিত এলাকা হলো নবায়নযোগ্য শক্তি, বিশেষ করে গ্রিড-যুক্ত সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও ছাদের সৌর প্যানেল। মোট গ্রিড বিদ্যুতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অবদান রাখে এমন চারটি সৌর প্রযুক্তির অবস্থা নীচের টেবিলে দেখানো হয়েছে। সূর্যালোক থাকলে সোলার পার্কগুলো ক্রমাগত গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। অন্যান্য অন-গ্রিড প্রযুক্তি সরাসরি অবদান রাখছে যখন তারা গ্রিডে বিদ্যুৎ পাঠাচ্ছে। অন্য সময়ে, অফ-গ্রিড প্রযুক্তির মতো তারা পরোক্ষভাবে ভোক্তার উপর লোড কমিয়ে অবদান রাখছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি-২০০৮ পাশ হওয়ার পর থেকে গত ১৫ বছরে এই ফ্রন্টে অর্জন হতাশাজনক। সৌরশক্তির মাধ্যমে উৎপাদিত মাত্র ৬৭৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গ্রিডে অবদান রাখা হচ্ছে। প্রতিদিনের শক্তি বক্ররেখা বিশ্লেষণ করে এই ব্যর্থতার প্রভাব বোঝা যায়। সৌর পিভি বিদ্যুতের অবদান দৈনিক শক্তি কার্ভ চিত্র থেকে দেখা যায়। যা দেখায় কীভাবে ১৮ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করা হয়েছিলো। এই সময়ের মধ্যে চাহিদা মেটাতে গ্রিড অপারেটর তেল-চালিত (প্রধাণত এইচএফও কিন্তু কিছু ডিজেল) পাওয়ার প্ল্যান্ট পাঠায়। এখানে আশ্চর্যের বিষয় হলো পর্যাপ্ত পরিমাণের বেশি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকা সত্ত্বেও জ্বালানির অভাবে পূর্ণ চাহিদা মেটানো যায়নি ও আমাদের লোডশেডিং-এর আশ্রয় নিতে হয়েছে। সূর্য যখন আলো ছড়ায় তখন লোডশেডিং হয় তা কল্পনাতীত। লোডশেডিং সহ এইচএফও ও ডিজেল পাওয়ার প্ল্যান্ট দ্বারা সরবরাহ করা বিদ্যুৎ সোলার পিভি দ্বারা সরবরাহ করা যেতে পারে। গ্রিডের পর্যাপ্ত সৌর পিভি ক্ষমতা থাকলে তারা তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত জ্বালানি সংরক্ষণের পাশাপাশি লোডশেডিং প্রতিরোধ করতে পারতো। গত ১৫ বছরে আমরা ২০,০০০ মেগাওয়াটের বেশি সামষ্টিক উৎপাদন ক্ষমতা সহ জীবাশ্ম-জ্বালানিযুক্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো তৈরি করতে পেরেছি। তবে ৫০০ মেগাওয়াটের কম ক্ষমতার সৌর পিভিপাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি করতে পেরেছি।
বাংলাদেশে যদি ২,০০০ মেগাওয়াট সমষ্টিগত উৎপাদন ক্ষমতা সহ গ্রিড-সংযুক্ত সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকতো, যা অস্থিতিশীলতার সমস্যা ছাড়াই গ্রিডে স্থান দেওয়া যেতো, তাহলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা যেতো ও দেশটি আরও বেশি জ্বালানি নিরাপত্তা পেতো। দিনের বেলায় আরও ২,০০০ মেগাওয়াট সৌরশক্তি মিটমাট করার জন্য বিরতি (ক্লাউডজ দিনের জন্য আবরণ) পরিচালনা করার জন্য পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকতে হবে। নীচের সারণীতে দেখা যায় যে, ১,৫০০ মেগাওয়াটের কম ক্ষমতার গ্যাস-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র (গ্যাস টারবাইন) রয়েছে যা এই কাজটি সম্পাদন করতে পারে। অবশ্যই প্রচুর তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে তবে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুতের ইউনিট খরচ অনেক বেশি। এটা পরিহাসের বিষয় যে, বিদ্যমান প্ল্যান্টের প্রায় ৫০ শতাংশ (৫,০০০ মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন ক্ষমতাসহ) নিষ্ক্রিয় বসে থাকা সত্ত্বেও আমাদের আরও গ্যাস-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজন। শুল্ক কম রাখতে ও গ্রিডে আরও সৌর পিভি বিদ্যুৎ যোগ করতে গ্যাস-চালিত পাওয়ার প্লান্টগুলোকে সাধারণ (একক) চক্র হতে হবে, সম্মিলিত চক্র নয়। যার মধ্যে আমাদের প্রচুর পরিমাণ পিভি রয়েছে যা অতিরিক্ত ক্ষমতার প্রধান কারণ। জ্বালানি আমদানি করে যে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না ও অভ্যন্তরীণ সম্পদই জ্বালানি নিরাপত্তা জোরদার করার একমাত্র মাধ্যম তা উপলব্ধি আশা করা যায় বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের হয়েছে। ক্রমাগত গ্যাস অনুসন্ধান ও নবায়নযোগ্য শক্তির শোষণ দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার দুটি স্তম্ভ হওয়া উচিত। উন্নতমানের কয়লার অবহেলিত মজুদও বিবেচনা করা উচিত। একটি উন্নয়নশীল দেশ একটি নির্দিষ্ট সীমার বাইরে ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে জ্বালানি আমদানি করতে পারে না। লেখক : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রকৌশল অনুষদের সাবেক ডিন। অনুবদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : ডেইলি স্টার