দোযখের বাসিন্দারা কি অনন্তকাল আগুনে পুড়বে
পারভেজ আলম
দোযখের বাসিন্দারা কি অনন্তকাল আগুনে পুড়তে থাকবে, নাকি একদিন তাদের এই শাস্তির সমাপ্তি ঘটবে, তা নিয়া আলেমদের মধ্যে বিতর্ক ছিল অনেক। কঠিন হৃদয়ের আলেমরা ভয় দেখাইতেন যে এই শাস্তি চলবে অনন্তকাল ধরে। আর সুফিরা সাধারণত এই শাস্তির সমাপ্তির আশা দিতেন মানুষরে। রাবেয়া বসরি এক বালতি পানি নিয়া ঘুরতেন দোযখের আগুন নিভানোর উদ্দেশ্যে।
ইবনে আরাবীর তত্ত্ব অবশ্য ছিল খানিকটা জটিল। তিনি বলতেন যে আগুন নিভবেনা কোনদিন। কিন্তু দোযখের বাসিন্দারা এক পর্যায়ে ঐ আগুনের মধ্যেই সুখ ও শান্তি লাভ করবে। এই তত্ত্বের গূঢ অর্থ হইল যে, দোযখের বাসিন্দাদের যেই ফিতরত বা স্বভাব (তাদের নফসে আগুনের প্রভাব বেশী থাকার কারনে), তার সাথে তারা শান্তি স্থাপন করতে পারবে। নিজেদের ফিতরত থেইকা তখন আর তারা এলিয়েনেটেড থাকবে না। ঠিক যেমন বেহেশতের বাসিন্দারাও নিজেদের ফিতরত বা আসল স্বভাবের উপর বর্তমান থাকতে পারবে।
ঢাকার সন্তান হওয়ায় ইবনে আরাবীর এই তত্ত্বটা মানতে আমার কষ্ট হইছে। আমিতো জানি আমার জন্মস্থান ঢাকার বাসিন্দারা কীভাবে নদী, খাল, মাঠ, বাগিচা ও জংগলে পরিপূর্ণ ছিমছাম মফস্বল ধরণের একটা শহররে দুনিয়ার হাবিয়া বানাইয়া ফেলছেন। এবং এই নিয়া তাদের মধ্যে কোন লজ্জা বা পাপবোধ নাই। কোন অপরাধবোধ নাই। নাই কোন দ্রোহ। যেনবা তারা ঠিক নিজেদের নফসের মতো একটা নগর তৈরি কইরা শান্তিতে আছেন। আমিই যেনবা এই নগরের উপযুক্ত বাসিন্দা না। এই যে এখন ঢাকা শহরে নানান রকম বিস্ফোরণের আগুনে আমাদের ভাই, বোন, বন্ধু, প্রতিবেশীদের মৃত্যু একটা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়ে গেল, আমি কি তবে এই বাস্তবতার সাথে শান্তি স্থাপন করবো? নিজের নফসের উপযুক্ত বেহেশতের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টায় থাকবো?
এতো দূর থেকেও এই বাস্তবতার সাথে শান্তি স্থাপন করতে পারি না বলেই আরাবীর চাইতে ইবনে তাইমিয়ার তত্ত্ব এইক্ষেত্রে আমার বেশী পছন্দ। তাইমিয়া তাসাউফের বিরুদ্ধে নানান সমালোচনা করলেও শেষ জীবনে নিজেই সুফিদের অনেক ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হইয়া গেছিলেন। তিনিও তাই এক পর্যায়ে ঘোষণা দিলেন যে দোযখের আগুনে পোড়ার শাস্তি অনন্ত নয়। একদিন এই শাস্তি শেষ হবে। দোযখ শূন্য হবে। ক্যাসলভানিয়ার ভ্রষ্ট সুফি চরিত্র আইজাক এই ধরণের মতের পক্ষে একটা হাদিস শোনায় প্রায়ইঃ “ওয়ান ডে হেল উইল বি এম্পটি, এন্ড ইটস ডোরস উইল র?্যাটল ইন দা উইন্ড”।
ঢাকার নিয়তি কি তবে দোযখই থাকা? ঢাকার বাসিন্দাদের নিয়তি কি এই দোযখের মধ্যেই শান্তি খুঁজে পাওয়া? নাকি এই দোযখের পথঘটগুলা একদিন শূন্য পরে থাকবে। ওয়েস্টার্ন সিনেমার কোন ঘোস্ট টাউনের মতো শূন্য ঘরের দরজা কপাটগুলা হু হু বাতাসের তোড়ে দেয়ালের সাথে ধাক্কা খাইতে থাকবে?
নাকি এই নগরের মানুষের জন্যে এর বাইরেও অন্য কোন নিয়তি আছে? তারা কি পারবেন নিজেদের ঘর আর প্রতিবেশকে দুনিয়ার বেহেশত, তথা জান্নাতুল মাওয়া বানাইতে? দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, আপাতত অমন কোন আশা দেখতাছিনা।
যারা নিজেদের নিয়তি পালটায় না, আল্লাহ তাদের নিয়তি পাল্টান না।
(এই লেখাটা লিখছিলাম ২০২৩ সালের ৮ মার্চ। মাত্র এক বছর আগে ঘটা আরেকটি দুর্ঘটনার সময়। কিছুই পাল্টায় নাই এই এক বছরে। অন্তরে যারা সদাই আগুন নিয়া ঘোরে, নগরের আগুন তাদের কাছে খুব বেশি পাত্তা পাওয়ার কথাও না। আগামীকালই ভুলে যাবেন আপনারা। অথবা এক সপ্তাহ পর। এইতো।) (লেখক: প্রবাসী এক্টিভিস্ট)