কর-জিডিপি অনুপাত, কর-মুক্ত আয় এবং দেশের কর আইন
ধীমান চৌধুরী : আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত বিশ্বের সর্বনিম্ন। এটি এখানে ১০ শতাংশের কম, ভারতে ১৩ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ১১ শতাংশ ও পশ্চিমা দেশগুলোতে ৩০ শতাংশের বেশি। কর রাজস্ব বাড়ানোর জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর চাপ রয়েছে। বিভিন্ন বৈষম্যমূলক ছাড় ও ভাতা (করমুক্ত আয়) কম কর রাজস্বের অন্যতম প্রধান কারণ। একজন ব্যক্তির আয়: বাংলাদেশে, আয়কর আইন ২০২৩ অনুযায়ী, একজন ব্যক্তির আয়ের সাতটি বিভাগ থাকতে পারে যেমন চাকরি থেকে আয়, কৃষি থেকে আয়, ভাড়া থেকে আয়, সুদের আয়, ব্যবসা থেকে আয়, মূলধন লাভ, অন্যান্য আয় যেমন লভ্যাংশ ও রয়্যালটি। মূলধন লাভ ব্যতীত এই আয়গুলো (মূলধন লাভ ১৫ শতাংশ পৃথক হারে কর দেওয়া হয়) যোগ করা হয়, কিছু ছাড় (করমুক্ত আয়) বাদ দেওয়ার পরে করযোগ্য আয় নির্ধারণ করা হয় এবং ৫ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত স্ল্যাব হারে কর নেওয়া হয়। এই গ্রস ট্যাক্স থেকে, অনুমোদনযোগ্য বিনিয়োগের জন্য ক্রেডিট দেওয়া হয়, অগ্রিম ট্যাক্স দেওয়া হয় ও উৎসে কর কর্তন করা হয়।
করমুক্ত আয়: উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কিছু পরিমাণ করমুক্ত আয় রয়েছে। ব্যাপক বেকারত্ব, উপযুক্ত কাজ ও বেতনের অভাব এই কর বিধানের কারণ। উন্নত দেশগুলোতে করমুক্ত আয়ের এই বিধান নেই। এখানে মাত্র কয়েকটি ছাড়া সব আয় করযোগ্য। নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য (চাকরিতে): কর্মসংস্থান থেকে আয় টাকা পর্যন্ত করযোগ্য আয় থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ৪৫০,০০০ বা এই আয়ের এক-তৃতীয়াংশ যা কম হয় (আয়কর আইন ২০২৩, ষষ্ঠ তফসিল, অনুচ্ছেদ ২৭)। তাছাড়াও, সর্বনিম্ন টাকা পর্যন্ত সাধারণ ছাড় পাওয়া যায়। করযোগ্য আয় থেকে ৩৫০,০০০। মহিলা ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এই সাধারণ ছাড় বেশি। কাজেই চাকরিজীবীদের জন্য মোট টাকা ন্যূনতম ৮০০,০০০ ট্যাক্স মুক্ত। অর্থাৎ চাকরিরত একজন ব্যক্তি মাসিক বেতন পাচ্ছেন টাকা ৬৬,৬৬৭ টাকা তাহলে তার কর্মসংস্থান আয়ের উপর কর দিতে হবে না। মাথাপিছু আয় বিবেচনা করলে এই পরিমাণ অনেক বেশি।
৪৫০,০০০ টাকা ট্যাক্স-মুক্ত: ৪৫০,০০০ টাকা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। বাড়ি ভাড়ার জন্য ৩০০,০০ টাকা, চিকিৎসার জন্য ১২০,০০০ ও পরিবহনের জন্য ৩০,০০০ টাকা। এগুলোকে অপরিহার্য হিসাবে ধরে নেওয়া হয়েছে যার উপর কর দিতে হবে না। তার ওপরে ৫০ হাজার টাকা। চাল ও লিন্টেলের মতো মৌলিক প্রয়োজনীয়তার জন্য ৩৫০,০০০ টাকা বেঁচে থাকার পরিমাণও বিবেচনা করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে কর আইনের এই বিধান মারাত্মক বৈষম্যমূলক। চাকুরীজীবীদের জন্য এক পরিমাণ করমুক্ত আয় (৮০০,০০০ টাকা) ও অ-নিয়োজিতদের জন্য আরেকটি পরিমাণ করমুক্ত আয় (৩৫০,০০০টাকা) অগ্রহণযোগ্য। যদি চিকিৎসা, বাড়ি ভাড়া, পরিবহন (সর্বমোট ৪৫০,০০০ টাকা) নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হয়, তবে এটি একইভাবে অ-কর্মসংস্থানকারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। অ-নিযুক্ত ব্যক্তিদেরও চিকিৎসা, বাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তার জন্য তাদের আয় (কর্মসংস্থান আয় ব্যতীত) থেকে কিছু পরিমাণ আলাদা করতে হবে। একজন নাগরিকের কথা চিন্তা করুন যিনি একা সুদের আয়ের উপর জীবনযাপন করেন। তার ও তার পরিবারের কি আবাসনের মতো ন্যূনতম প্রয়োজন নেই? অথবা, এমন একজন ব্যক্তির কথা ভাবুন যিনি একা ভাড়ার আয়ে (বাড়ির সম্পত্তি) বসবাস করেন। তার কি চিকিৎসা ও পরিবহনের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসের প্রয়োজন নেই? অতএব, যদি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর জন্য কিছু করমুক্ত আয়ের ব্যবস্থা থাকে তবে তা সমস্ত নাগরিককে সমানভাবে দেওয়া উচিত। তারা কর্মসংস্থান বা ভাড়া আয় বা সুদের আয় থেকে আয় করুক না কেন।
মোট করযোগ্য পরিমাণের উপর কর-মুক্ত আয় ও আয়ের বিশেষ শ্রেণিতে নয়: করমুক্ত আয় মোট করযোগ্য আয়ের উপর ভিত্তি করে। যদি একটি নির্দিষ্ট আয়ের কর-মুক্ত উপাদান থাকে, তবে তা একত্রে আয়ের সমস্ত বিভাগের জন্য মোট করমুক্ত আয়ের বেশি হবে না। আমাদের দেশে একজন নাগরিক যার শুধু কৃষি আয় ও সর্বোচ্চ টাকা সুদের আয়। ২০,০০০টাকা অতিরিক্ত করমুক্ত আয় পায়। ৫৫০,০০০ করমুক্ত আয়। তাহলে সরকার এটা করলো কেন? সরকার পার্থক্যটা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবেনি। দ্বিতীয়ত, নীতিনির্ধারকরা বেশিরভাগই নিযুক্ত ব্যক্তি যারা নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবেছিলেন। তৃতীয়ত, অধিকাংশ লোকের কোনো না কোনো কর্মসংস্থান আছে। কর্মসংস্থানের আয় ব্যতীত অন্য আয়ের মাধ্যমে বসবাসকারী লোকেরা সংখ্যালঘু। উপসংহারে বলা যায়, দেশের সকল মানুষের জন্য করমুক্ত আয়ের পরিমাণ সমান হওয়া উচিত। টাকা করমুক্ত আয়। দেশের সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে ৩৫০,০০০ কম। টাকা এর তো একটি মধ্যবিন্দু। ৫০০,০০০ কর্মরত ও অ-কর্মসংস্থান নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য উপযুক্ত বলে মনে হচ্ছে। ট্যাক্স আইনও পরোক্ষভাবে এই পরিমাণকে করমুক্ত আয়ের একটি যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ বিবেচনা করে (৫৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত কৃষি আয়ের জন্য করমুক্ত আয়, বিনিয়োগের উপর ট্যাক্স ক্রেডিট পাওয়ার যোগ্যতার জন্য সরকারী সিকিউরিটিজে সর্বোচ্চ ৫০০,০০০ টাকা বিনিয়োগ ইত্যাদি)
লেখক : পিএইচডি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান।
অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : দি ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস