বাংলাদেশ কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত?
হীরেন পন্ডিত : চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে প্রযুক্তি খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। প্রযুক্তির এই প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এটি সম্ভাবনার দরজা খুলতে পারে আবার নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসতে পারে। ধনী ও দরিদ্র দেশের মধ্যে ব্যবধান আরও বিস্তৃত হতে পারে। চাকরিগুলোকে অদক্ষ-নিম্ন-পেইড ও উচ্চ-দক্ষ-উচ্চ বেতনে ভাগ করা হবেÑ এই বিভাগে, দক্ষ লোকেরা চাকরি পাবে, অদক্ষ লোকেরা বেকার হয়ে যেতে পারে। হিউম্যান বডিতে চিপ বসানোর প্রযুক্তি বেরিয়ে এসেছে। ভবিষ্যতে, বডিতে লাগানো চিপগুলো বিভিন্ন স্বাস্থ্য তথ্য সরবরাহ করতে সক্ষম হবে। চিপগুলো মানুষের গোপনীয়তার সঙ্গে আপস করতে পারে। এই স্মার্ট ডিভাইসগুলো বাংলাদেশের জন্য বিশেষ করে পোশাকশিল্পের জন্য দুঃসংবাদ বয়ে আনতে পারে। এ খাতে প্রায় ৬০ লাখ শ্রমিক কাজ করে। রোবট ও স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহারের মাধ্যমে এসব শ্রমিকের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে। অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে যেতে পারে। শুধু পোশাকশিল্প নয়, আরও অনেক পেশার ওপর নির্ভরতা কমবে, রোবট ও মেশিনের ব্যবহার বাড়বে। চালকবিহীন গাড়ি চালু হলে চালকদের চাকরিও অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে। উন্নত বিশ্বে চালকবিহীন গাড়ি নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। চালকবিহীন গাড়ি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও দক্ষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া যানজট ও দূষণ কমবে। আমাদের দেশে অনেক চালক চাকরি হারাবেন। অন্যদিকে মেধাভিত্তিক পেশা যেমন প্রোগ্রামার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তা বাড়বে।
আমাদের দেশে দক্ষ প্রোগ্রামারের অভাব রয়েছে। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হবে। আমাদের দক্ষ প্রোগ্রামার তৈরি করতে হবে। ডিজিটালাইজেশনের কারণে এখন প্রচুর ডেটা তৈরি হচ্ছে। আমাদের স্মার্ট কারগুলো আমরা কোথায় যাচ্ছি ও আমরা কতোটা সময় ব্যয় করছি তার ডেটা পাচ্ছে। আমাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, মোবাইল ওয়ালেট ও ক্রেডিট কার্ড আমাদের খরচের জন্য হিসাব করতে পারে। স্মার্টফোন ও স্মার্ট টিভিতে আমরা যা দেখছি তার ডেটা থাকে। এই ডেটা আগে সংরক্ষণ করা যায়নি। এখন ক্লাউডে সংরক্ষণ করা সহজ ও সস্তা। দ্রুত প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতার কারণে, কম্পিউটার সহজেই এই ডেটা বিশ্লেষণ করবে ও সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে। কম্পিউটারকে দেওয়া হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এআই পূর্ববর্তী পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে ডেটা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কম্পিউটার একটি প্যাটার্ন অনুমান করতে পারে। ফলে, কম্পিউটার পরে রঙ, আকার ও অঙ্গবিন্যাস দ্বারা বিষয় চিনতে পারে। বর্তমানে, যেকোনো লেনদেন একটি খাতায় রেকর্ড করা হয়। ডিজিটাল বাংলাদেশের পাঁচটি উদ্যোগ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এগুলো হলো ডিজিটাল সেন্টার, সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ড, কম্প্যাশন ট্রেনিং, টিসিভি ও এসডিজি ট্র্যাকার। তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে তরুণরা ছোট আকারের আইটি ফার্ম, ই-কমার্স সাইট, অ্যাপ-ভিত্তিক পরিষেবা ও অন্যান্য কোম্পানি তৈরি করছে। এছাড়া বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটসহ মহাকাশে কিছু বড় অর্জন বাংলাদেশকে বিশ্বে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। অ্যাপ ভিত্তিক সেবাও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অনেকেই এখন দৈনিক ক্রিয়াকলাপ, উৎপাদন, বিক্রয়, বিপণনে সময়, শ্রম ও খরচ কমাতে প্রযুক্তি বেছে নিচ্ছেন। বড় কোম্পানিগুলো ইআরপি (এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং) সফটওয়্যার ব্যবহার করছে।
তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) একটি বড় অংশ মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করছে। মহামারী মোকাবিলা থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার দেখছে বিশ্ব। আগামী দিনে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ব্যবসার ধারণা আমূল পরিবর্তন করবে। ভবিষ্যতে বিজ্ঞানীরা চিকিৎসা পরিষেবা, অফিস-আদালত, শিল্প-কারখানা, সংবাদ সংস্থা বা মিডিয়া, ভাষা অনুবাদ প্রক্রিয়া, টেলিফোন পরিষেবা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মেশিন বা রোবটের ব্যাপক ব্যবহারের আভাস দেবেন। হোটেল-রেস্তোরাঁ ও এমনকি বিপণন। এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে আমাদের রিস্কিলিং ও আপস্কিলিং দরকার। আগামী বছরগুলোতে, কোনও মহামারী প্রতিরোধে সংযোগের চাহিদা আরও বাড়বে। প্রচলিত প্রযুক্তির পরিবর্তে উচ্চ-গতির ফাইবার অপটিক-ভিত্তিক সংযোগের প্রচার করা উচিত। টেলিমেডিসিন পরিষেবা, দূরত্ব শিক্ষা, অনলাইন প্রশিক্ষণ, মহামারী এলাকা চিহ্নিতকরণ, সামাজিক নিরাপত্তা তালিকাভুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও বড় ডেটা অ্যাপ্লিকেশন বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া ই-কমার্স, আউটসোর্সিং, ফ্রিল্যান্সিং, ভিডিও স্ট্রিমিং, সোশ্যাল মিডিয়ার বর্ধিত চাহিদা মেটাতে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্কের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে, একটি ৫-জি নেটওয়ার্ক সময়ের প্রয়োজন। বাংলাদেশ ৫-জি প্রযুক্তি চালু করার পরিকল্পনা নিয়েছে।
টেলিকম আধিকারিকদের ৫এ-এর জন্য প্রশিক্ষিত ও ক্ষমতায়িত করতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে তথ্য প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে পরিবর্তনশীল জীবন ব্যবস্থায় এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে অগ্রগামী হতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য বাংলাদেশের প্রযুক্তি পরিবেশে অবকাঠামো-প্রযুক্তিগত প্রস্তুতিকে সমর্থন করার ওপর জোর দিতে হবে। বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশের জন্য বেশ কিছু সমস্যা সমাধান করতে হবে। প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যার ও সিস্টেম অবশ্যই জায়গায় থাকতে হবে। বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কৌতূহলী। এসব কৌতূহলী তরুণদের মাধ্যমে দেশের অগ্রগতিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশে কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪৭ শতাংশ। তথ্যপ্রযুক্তি সহজলভ্যতার একটি ধারণা আছে কিন্তু সম্পূর্ণ ধারণা এখনও পাওয়া যায়নি। সবার আগে তথ্য প্রযুক্তিকে সকল মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে হবে। এজন্য সরকারি উদ্যোগে তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করতে হবে ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে। এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি যাতে স্বল্প খরচে দরিদ্র মানুষ ও নারীরা ব্যবহার করতে পারে সে উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও রিসার্চ ফেলো। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : ডেইলি অবজার্ভার