আর্থিক সাক্ষরতা, গ্রাহকদের সচেতনতা ও আর্থিক ব্যবস্থা
এম এ মাসুম : ৪ মার্চ, সোমবার ‘আর্থিক সাক্ষরতা দিবস’ গেছে। দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দ্বিতীয়বারের মতো একটি ‘আর্থিক সাক্ষরতা দিবস’ উদযাপন করেছে যাতে গ্রাহকদের সচেতনতা বাড়াতে, আর্থিক বিষয় ও পরিষেবা সম্পর্কে জ্ঞান প্রদানের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রমের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২ সালের ২৭ মার্চ ‘আর্থিক সাক্ষরতা নির্দেশিকা’ জারি করেছে ও ঘোষণা করেছে যে প্রতি বছর মার্চ মাসের প্রথম সোমবার ‘আর্থিক সাক্ষরতা দিবস’ পালিত হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন থেকে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য আর্থিক অন্তর্ভুক্তি প্রচারের জন্য বেশ কয়েকটি উদ্যোগকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। অগ্রাধিকারের ফোকাস হিসাবে, বিবি তার ২০২০-২০২৪ এর কৌশলগত পরিকল্পনায় আর্থিক সাক্ষরতা ও আর্থিক শিক্ষার উদ্যোগকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল উদ্দেশ্য হিসাবে চিহ্নিত করেছে। ভবিষ্যতে বা অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য যৌক্তিক আর্থিক পরিকল্পনা করার জন্য আর্থিক ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সমস্ত লোকের যথাযথ জ্ঞান থাকা অপরিহার্য। এই আচরণগত পরিবর্তন মূল আর্থিক বিষয়ে সাধারণ সাক্ষরতার মাধ্যমে প্রভাবিত হতে পারে। এই কৌশলগত ফোকাস এভাবে পর্যাপ্তভাবে কিছু আর্থিক বিষয়ের উপর ধারণাগত ঝোঁকের আলোচনার সমাধান করে। যেমন: সঞ্চয়, ঋণ বা অর্থপ্রদান যা ব্যক্তির প্রভাবশালী আর্থিক সিদ্ধান্তে সাহায্য করতে পারে ও আর্থিক বাস্তুতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে পারে। আর্থিক সাক্ষরতার মাসটি কানাডায় নভেম্বর মাসে বার্ষিক স্বীকৃত হয়। ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক সাক্ষরতার মাস স্বীকৃত হয়। আর্থিক সাক্ষরতার গুরুত্ব তুলে ধরার ও নাগরিকদের কীভাবে স্বাস্থ্যকর আর্থিক অভ্যাস স্থাপন, বজায় রাখা যায় তা শেখানোর প্রয়াসে।
গত দুই দশকে দেশের আর্থিক ব্যবস্থা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। ঐতিহ্যবাহী ব্যাংকিং ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে পরিবর্তিত হয়েছে। ইন্টারনেট ও প্রযুক্তিনির্ভর সেবার কারণে আর্থিক সেবা সত্যিই গ্রাহকদের হাতে এসেছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, একই সঙ্গে আর্থিক সেবা প্রক্রিয়ারও উন্নতি হচ্ছে। টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং খাতের বাস্তবায়ন এই পর্যায়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ধারণাটি বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, বিশেষ করে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। এজেন্ট ব্যাংকিং বাংলাদেশে ব্যাংকিং-বিহীন ও নিম্ন-ব্যাংকের জনগোষ্ঠীর কাছে আর্থিক সেবা প্রসারিত করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাধান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের কারণে গ্রাহকের সংখ্যা ও লেনদেন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রামীণ এলাকার অর্থনৈতিক দৃশ্যপট দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। এজেন্ট ব্যাংকিং বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক। এটি এজেন্ট আউটলেটের মাধ্যমে সারাদেশে সুবিধাবঞ্চিত ও ব্যাংকবিহীনদের আর্থিক পরিষেবা প্রদান করে। এটি জাতীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে; বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়। ২০১৩ সালে সূচনা হওয়ার পর থেকে, এজেন্ট ব্যাংকিং তার উচ্চ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার সঙ্গে ব্যাংকিং সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ঈর্ষণীয় সাড়া পেয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে স্বল্প আয়ের মানুষ ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং খাতের আওতায় আনতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অংশ হিসাবে, দরিদ্র কৃষকদের শুধুমাত্র ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় সরকারের বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অর্থ বিতরণ, হতদরিদ্র মুক্তিযোদ্ধা, ক্ষুদ্র জীবন বীমা গ্রহীতা, বেকার যুবক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, গার্মেন্টস কর্মী, অতি দরিদ্র সুবিধাভোগী, অতি দরিদ্র মহিলা সুবিধাভোগী, ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির সুবিধাভোগীরা রয়েছে। ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে দরিদ্রদের পুনর্বাসনের জন্য প্রাপ্ত অনুদানকেও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে উৎসাহিত করা হয়। প্রথাগত ব্যাংকিং চ্যানেলে সক্রিয় অংশগ্রহণের অনুপস্থিতিতে হ্যান্ডসেট-ভিত্তিক সমাধানের ব্যাপক গ্রহণের দ্বারা চালিত বিশ্বব্যাপী নিম্ন ও মধ্যম আয়ের সমকক্ষদের তুলনায় বাংলাদেশে মোবাইল আর্থিক পরিষেবা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, দেশে নিবন্ধিত মোবাইল মানি অ্যাকাউন্টগুলো বছরে ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবরে ২১.৭৭ কোটিতে দাঁড়িয়েছে যা আগের বছরে ১৮.৭৫ কোটি ছিলো।
আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য জোর দেওয়া সত্ত্বেও ওয়ার্ক ব্যাংকের জরিপ অনুসারে, জনসংখ্যার একটি বড় অংশ ব্যাংকমুক্ত রয়েছে এমন শীর্ষ সাতটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। এর প্রায় ১৭০ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে প্রায় ৩০ মিলিয়নের এখনও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা মোবাইল মানি প্ল্যাটফর্মে একটি অ্যাকাউন্ট নেই। বিশ্বের ১.৪ বিলিয়ন ব্যাংকবিহীন জনসংখ্যার মধ্যে অর্ধেক বা ৭৪০ মিলিয়নের বেশি আসে চীন, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সহ সাতটি অর্থনীতি থেকে। ২০২১ সালে বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশের একটি অ্যাকাউন্ট ছিলো, যা ২০১৭ সালে ৫০ শতাংশ ছিলো। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি সমর্থনে আর্থিক সাক্ষরতা অপরিহার্য, বিশেষ করে ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস এর অগ্রগতির প্রেক্ষাপটে। বর্তমানে বেশিরভাগ বেসরকারি ব্যাংকের কার্যক্রম শহরাঞ্চলে কেন্দ্রীভূত, যা গ্রামীণ জনগণের নাগালের বাইরে রয়েছে। দেশের সব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকের আওতায় আনতে হলে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। অর্থপ্রবাহকে বহুমুখী করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে, যা সামষ্টিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। গ্রাম পর্যায়ে ব্যাংকিং সেবা সম্প্রসারণের জন্য এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম বাড়াতে হবে। আর এ কারণে আর্থিক সাক্ষরতার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশ সরকার দেশকে স্মার্ট করার জন্য বহুমুখী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে ও বাস্তবায়ন করছে। বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যাকে আর্থিক চ্যানেলের বাইরে রেখে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার কোনো মানে হবে না।
লখক: ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি-এর সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : ডেইলি অবজার্ভার।