আল্লাহর ওয়াস্তে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের পক্ষে কথা বলিয়েন না
আরিফ জেবতিক
আল্লাহর ওয়াস্তে এই মুহুর্তে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের পক্ষে কোন কথা বলিয়েন না। কেন বলবেন না, সেটা ব্যাখ্যা করি।
আমি গার্মেন্টস ব্যবসায় ঢুকি ১৯৯৮ সালে। অন্তত ২শ গার্মেন্ট কারখানায় আমি কাজ করিয়েছি। ট্রাস্ট মি. শুধুমাত্র কেয়ারলেস থাকার কারনে, মানুষের জীবনকে বিন্দুমাত্র মূল্য না দেয়ার কারনে অধিকাংশ গার্মেন্ট কারখানায় মানুষ মরতে দেখেছি। প্রায় সময়ই গার্মেন্ট কারখানার ইমার্জেন্সি সিড়ি তালাবদ্ধ থাকত। জাস্ট দেড় হাজার টাকার একজন দারোয়ান রাখবে না বলে দ্বিতীয় সিঁড়ি তালা মেরে রেখে দেড় হাজার শ্রমিককে প্রতিটি মুহুর্তে মৃত্যু ঝুঁকিতে রাখতে দেখেছি। ছাদে উঠে শ্রমিকরা আড্ডা মারবে, এই অজুহাতে ছাদ বন্ধ থাকত। পানির বিল বাড়বে বলে আগুন নির্বাপনের রিজার্ভ ট্যাংকিতে পানি রাখত না। সারামাসে মাত্র আধাঘন্টার প্রোডাকশনের ক্ষতি হবে বলে ফায়ার ড্রিল করানো হতো না।
এসব নিয়ে কথা বললেই অধিকাংশ গার্মেন্ট কারখানার মালিকই আমাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল, আমরা মরে গেলুম, দেশের এক্সপোর্ট শেষ হয়ে গেল’ বলে হইচই লাগাতো। ভালো ভবনে যাওয়ার প্রস্তাব উড়িয়ে দিয়ে সবাই বলত, পুঁজি কই? সরকার তুমি টাকা দাও।
এই ঘটনার নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে ২০১৩ সালে, রানাপ্লাজার দুর্ঘটনার পরে। বিদেশী বায়াররা প্রচন্ড চাপে পড়ল। তারা একসাথে বলল, গুষ্ঠী মারি তোর ব্যবসার। যে ফ্যাক্টরি কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করবে না, সেখানে ব্যবসা করতে পারব না।
আপনি খেয়াল করে দেখবেন, পরবর্তী ২ বছরের মধ্যে ঢাকায় যেসব শপিংমলের উপরে গার্মেন্ট কারখানা ছিল, প্রায় সবগুলো বন্ধ হয়ে গেল। কারখানাগুলো গাজীপুর, আশুলিয়া, সাভার অঞ্চলে নিজেদের ভবনে চলে গেল। এখনও এসব কারখানায় আগুন লাগে না, এমন নয়। কিন্তু এখন আর প্রতিমাসে গার্মেন্ট শ্রমিকদের মৃত্যুর খবর আগের মতো হরেদরে পাওয়া যায় না। কারন ফ্যাক্টরিগুলোতে সিড়ি আছে, পানি আছে, নিরাপত্তার ট্রেনিং আছে, ছাদ খোলা আছে, ফায়ার এক্সটিংগুইশারের মেয়াদ আছে।
একই অবস্থা আমাদের ঢাকা শহরের এই রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী ও কমার্শিয়াল ভবনের মালিকদের। এদেরকে যদি আপনি নোটিশ দেন, সময় দেন, সুযোগ দেন- এরা এই সুযোগ কোন কাজে লাগাবে না। রেস্টুরেন্টের সিঁড়িতে এরা মালপত্র রাখবেই, ছাদ তালা মারবেই, অতিরিক্ত চেয়ার টেবিল, কিচেন সেটাপ দিবেই। এরা সেই গার্মেন্ট মালিকদেরই ভাই বেরাদর, যারা সিঁড়িতে এক্সপোর্টে কার্টন আর বড় বড় ডেনিম কাপড়ের রোল রেখে সিঁড়ি বন্ধ করে রাখত। এরা কেউ গরিব না। গুলশান বনানীর অধিকাংশ রেস্টুরেন্ট মাত্র কয়েকটি বড় গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করে। একই মালিকের একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, আরেকটি জাপানি রেস্টুরেন্ট তো তৃতীয়টি থাই রেস্তোরা। এদের টাকা পয়সার অভাব থাকলে একের পর এক রেস্টুরেন্ট ওপেন করত না। এদের টাকার অভাব নেই, সদিচ্ছার অভাব। এদের প্রতি দয়াদাক্ষিন্য দেখানোর কোন দরকার নেই।
সুতরাং এই ক্র্যাকডাউনকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করুন। কুম্ভকর্ণ সরকার যদি এখন একটু লাফায় ঝাপায়, তো তাদেরকে হাততালি দিন। চাপে না পড়লে এই লোকগুলো সিধা হবে না। চাপে পড়লে ঠিকই সিড়ি আর ছাদ পরিস্কার রাখা শুরু করবে, ফায়ার এক্সটিংগুইশার ফিট করবে।
ভাই রে, চুয়াল্লিশজন মানুষ মারা গেছে। আমার আপনার মতো মানুষ।
আমরা আজ বেঁচে আছি, কালকে হয়তো বাঁচব না।
নিজের জীবন, নিজের পরিবারের জীবন, নিজের সন্তানের জীবনকে তুচ্ছ করে কোন ব্যবসায়ী গোষ্ঠির জন্যই কোন মমতা দেখাবেন না প্লিজ। লেখক : ব্লগার এক্টিভিস্ট