আমরা কি পারি না প্যারিসের আদলে ঢাকায় রোড সাইড ক্যাফে করতে?
রুমি আহমেদ খান
একটা সময় ছিলো ঢাকার মধ্যবিত্তের কাছে রেস্টুরেন্ট একটা অনেক দূরের এলিয়েন কনসেপ্ট। ছিলো। পারিবারিকভাবে নিয়মিত রেস্টুরেন্টে ডাইন আউট করার কথা কেউ ভাবতেই পারতো না। কাঁচা বাজারগুলোতে ‘হোটেল’ নামে একটা-দুটা স্থাপনা থাকতো যেখানে ভাসমান মানুষ খাবার দাবার করতো আর বিকেলে ডালপুরী অথবা সিঙ্গারা ভাজা হতো। গুলিস্তান/স্টেডিয়াম এলাকাতে দু’একটা রেস্তোরাঁ। ছিলো সেখানেও ডিনার টাইমে তেমন ক্লায়েন্ট থাকতো না। আর কিছু কাবাবের দোকান। ছিলো। মিরপুর অঞ্চলে, মোহাম্মদপুর, ফার্মগেট ইত্যাদি অঞ্চলে। ফার্মগেট থেকে শাহবাগ এর দিকে যাবার যে রাস্তাটা ওখানে রাস্তার দুধারে কিছুই। ছিলো জলাভূমি ছাড়া। এখন যে সোনারগাঁ মোড় ওখানে বিলের উপর টং ঘরের মতো একটা স্থাপনায় দারুল কাবাব নাম একটা কাবাব হাউজ। ছিলো। এছাড়া ফার্মগেট থেকে বাংলা মোটর পর্যন্ত কিছুই। ছিলো না ঘুটঘুটে অন্ধকার জলা অঞ্চল ছাড়া। শাহবাগে তখন পিজি হাসপাতল ভবনের নিচতলায় কিছু রেস্তোরাঁ। ছিলো যার ক্রাউড। ছিলো মূলত ওই অঞ্চলের ছাত্র ছাত্রীরা।
শাহবাগ থেকে পুরোনো ঢাকাÑ মোটামুটি এই অঞ্চলে বেশ কিছু রেস্তোরাঁ ছাত্রদর কেটার করতো। কম্পারেটিভলি পুরোনো ঢাকায় কুট্টিদের মাঝে ডাইন আউট বা টেইকআউট কালচার বেশি পপুলার। ছিলো নতুন ঢাকার বাসিন্দাদের থেকে। সত্তর থেকে আশির দশকে চাইনিজ রেস্টুরেন্টগুলো ছড়িয়ে পড়তে থাকে দেশজুড়ে। ওইটাই হয়ে যায় দেশের মধ্যবিত্তের প্রধান ডাইন আউট প্লেস। তারপরও ওই চাইনিজ ডাইন আউট নিয়মিত কোনো ইভেন্ট। ছিলো না। বছরে/ছয়মাসে কোনো ইভেন্ট উপলক্ষে যাওয়া হতো। আসলে মধ্যবিত্ত তখনো ডাইনাউটের ততোটা প্রয়োজন বোধ করতো না। কাজ ছাড়াও ঘরের দরোজার বাইরের যাবার জায়গা। ছিলো তখনও। অধিকাংশ বাড়ির সামনে একটা উঠোন। ছিলো। তা না হলে সামনের রাস্তায় যেমন গাড়িঘোড়ার হট্টলা। ছিলো না। মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে জটলা পাইয়ে সময় কাটাতে পারতো। ছেলেমেয়েদের আউটডোর খেলার জন্য পর্যাপ্ত স্পেস। ছিলো। গৃহবধূরা প্রতিবেশীর বাসায় আসা যাওয়া করতেন নিয়মিতই। সব মিলিয়ে একটা ব্রিথিং স্পেস। ছিলো।
গত তিন যুগে আমরা দেশের শহর বন্দরগুলোকে কংক্রিটের বস্তি করে ফেলেছি। প্রতিটা ব্রিথিং স্পেস কংক্রিটের হাইরাইজ দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছি। আকাশ ঢেকে ফেলেছি হাইরাইজ আর স্মগ দিয়ে। মানুষের এখন আর কোথাও যাবার জায়গা নাই দরোজার ওপারে। হাইকিং, বাইকিং, রোইং, ক্লাইম্বিং, ফিসিং, ক্যাম্পিং ইত্যাদি আউটডোর একটিভিটি করার স্কোপ নেই, তাই কালচার গড়ে ওঠেনি। ঢাকা, চট্টগাম, নারায়াণগঞ্জ ইত্যাদি সব বড় শহরের একটা করে নদী আছে। কিন্তু ওই নদীতে কোনো ওয়াটার স্পোর্টস করার চান্স নেই। নদীর পারে গিয়ে কিছক্ষণ ফ্রেস বাতাস উপভোগ করার বা বসার কোনো ফুসরত নেই। আমাদের নদীগুলোর দুই মাইলর মাঝে যাওয়া যায় না পচা পানির দুর্গন্ধে, ওখানে গিয়ে ফ্যামিলি নিয়ে পিকনিক করা তো দূরের কথা। এই ব্যাকগ্রাউন্ডে গত একযুগে দেশের মানুষ বাইরে রেস্তোরাঁগুলোতে খেতে যাওয়াটাকে বাড়ির দরোজার ওপারে যাওয়ার একটা উপলক্ষ হিসেবে নিয়েছে। গত দশ বছরে দেশের রেস্টুরেন্ট কালচারে একটা বিপ্লব ঘটে গিয়েছে বাংলাদেশের বিশাল মধ্যবিত্তের এই ব্যাপক নিড টা মেটাতে। রেস্টুরেন্টের সংখ্যা হাজার গুন্ বেড়েছে, খাবার মান, গুণ, স্বাদ বেড়েছে। দাম কমেছে ।
শহরের রেস্তোরাঁ গুলা রাত বারোটা একটা পর্যন্ত জমজমাট থাকে। কারণ ঘরের বাইরে বের হয়ে রেস্টুরেন্ট ছাড়া আর কোথাও যাবার জায়গা নেই। ঢাকা শহরে লক্ষ লক্ষ মসজিদ যেমন একটা অত্যাবশ্যক প্রয়োজন মেটাচ্ছে এই রেস্টুরেন্টগুলোও একটা আরেক ধরনের এসেন্সিয়াল সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। আগে চাইনিজ বা অন্যান্য রেস্টুরেন্ট গুলো একতলা বা দোতালা স্ট্যান্ড এলোন ভবনে থাকত। এখন ওই ধরনের ভবনই প্রায় নাই শহরগুলোতে। অধিকাংশ রেস্টুরেন্টই এখন ব্যবসা করছে হাইরাইজ ভবনগুলোতে। বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের পর আমাদের একটা সাময়িক বোধদয় হয়েছে যে ঢাকা শহরে হাইরাইজ ভবনগুলোর রেস্টুরেন্টগুলোর ফায়ার রিস্ক খুব হাই। যদিও আমরা রেস্টুরেন্ট নিয়ে শুধু কথা বলছি। হাইরাইজ গুলোতে রেস্টুরেন্ট তো শুধু না বাসা বাড়ি, অফিস আদালত, ডাক্তারের চেম্বার, শোরুম ইত্যাদি সবই আছে। আমার ধারণা হাইরাইজ অকুপেন্সির ৯০ শতাংশই আবাসিক প্রয়োজনে ব্যবহার হয়। দেশের আবাসিক কমার্শিয়াল হাইরাইজ গুলো যেভাবে চার দিক দিয়ে গ্রিল দিয়ে জেলখানা বানানো হয়েছে – সব হাইরাইজ ই এক্সট্রিম ফায়ার রিস্কে আছে। আমি হাইরাইজ স্থাপনা বিশেষজ্ঞ না। তবে অনেকদিন পশ্চিমা বিশ্বে হাইরাইজ ভবনে কাজ করে বা থেকে বুঝেছি ফায়ার হ্যাজার্ড কমানোর জন্য সবচেয়ে জরুরি পার্টগুলা কী।
অগ্নিকাণ্ড রিস্ক মিটিগেশনের মূল ভরকেন্দ্র হচ্ছে স্টেয়ারকেস বা সিঁড়ি। প্রতিটি সিঁড়ির দরজা ফায়ারপ্রুফ পাল্লা দিয়ে ২৪/৭ বন্ধ থাকতে হবে। কোনো অবস্থায় ওই দরজাগুলো হা করে খোলা রাখা যাবে না। আর সিঁড়িগুলো ফায়ারপ্রুফ মেটেরিয়াল দিয়ে কন্সট্রাক্ট করতে হবে। একতলার আগুন আর ধোঁয়া এই সিঁড়িদিয়েই সারা ভবনে ছড়িয়ে পরে আর স্মোক ইনহেলেশন ই মৃত্যুর মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এই সিঁড়িগুলোই ফায়ার এস্কেপ হিসেবে কাজ করে। এই সিঁড়িগুলো স্টোরেজ হিসেবে অবস্ট্রাক্ট করে রাখা ফায়ার সেইফটির অন্যতম চরম ক্রিমিনাল নেগলিজেন্স। ওখানে গ্যাস সিলিন্ডার কেন, সামান্য একটা স্যু সেল্ফও রাখা যাবে না। আর প্রতিটি ফ্লোরে, প্রতিটি রুমে স্মোক এলার্ম থাকতে হবে। এভাবে সিস্টেম সেটাপ করতে হবে যাতে তিনতলার কিচেনে স্মোক এলার্ম ট্রিগার করলে সে এলার্ম পঞ্চাশ তোলা ভবনের সব ফ্লোরে ও রুমে বাজতে থাকবে। আর আগুন নেভানোর অটো স্প্রিঙ্কলার ও অনেক এফেকটিভ হতে পারে। প্রতিটা হাইরাইজ বিল্ডিংয়ে নিয়ম করে ফায়ার/এভাকুয়েশন ড্রিল করতে হবে। স্মোক এলার্মগুলোর ব্যাটারি চেক করতে হবে নিয়মিত। বাংলাদেশে একসময় প্রতিবছর লঞ্চ ডুবি হতো। প্রথমে হতো মেঘনা নদীতে। পরে শীতলক্ষ্যা নদীতে এখন কম হয়। কারণ টেকনোলজি সেই ছোট লঞ্চগুলো আর চলে না, বড় লঞ্চগুলো যেভাবে বিল্ট হয়েছে ওগুলোর ডোবার চান্স কম।
আগে নিয়মিত গার্মেন্টস গুলোতে আগুন লাগতো। এখন বায়ারদের চাপে এফেকটিভ ফায়ার সেইফটি মেজার্স নেওয়া হচ্ছে। আগুন ফ্রিকুয়েন্সি কমছে। এখন সবাই বলছে এই ভবন বন্ধ করো। ওটা সিলগালা করো। ওই রেস্তোরাঁগুলো ওখানে আছে একটা প্রয়োজনেই আছে। আজ রেস্টুরেন্টগুলো সব বন্ধ করে দিলে মানুষ কোথায় যাবে? ওদের কি আর কোনো যাবার জায়গা আছেন? শহরজুড়ে খালি কংক্রিটে জঙ্গল, অথবা উঁচু উঁচু ফেন্স। লুই কানের নকশা বলাৎকার করে সংসদ ভবনের বিশাল খোলা চত্ত্বর ফেন্স দিয়ে ঘিরে দিয়েছেন। মানুষ ওখানে যেতে পারে না। আমেরিকার রাজধানী ডিসি পার্লামেন্ট ভবনে (কংগ্রেস) আসুন – দেখবেন কি বিশাল ওপেন কনসেপ্ট খোলা চত্বর। পুরোনো বিমান বন্দরের রানওয়ে হতে পারতো একটা বিশাল খোলা চত্বর বা সেন্ট্রাল পার্ক। ওটাও দেয়াল দিয়ে বন্ধ আজ। পুরোনো ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় কারাগার সরে গিয়েছে। কিছু ঐতিহাসিক স্ট্রাকচার কনজার্ভ করে পুরো ক্যাম্পাসটা একটা দেয়ালবিহীন সবুজ ঘাসের খোলা চত্বর হতে পারতো। কিন্তু ওখানে নাকে সিটি কর্পোরেশন মার্কেট করবে। ঢাকা বুড়িগঙ্গার পারে। ওই নদীর তীরে হাঁটার জন্য কোনো ব্রডওয়াক কি আছে? অথবা পিকনিক ইত্যাদি করার জন্য কোনো পার্ক?
বুড়িগঙ্গার জল আর নিকষ কালোÑ যার উৎকট গন্ধ অক্সিজেন যা আছে ঢাকার বাতাসে, তাও কেড়ে নেয়। প্যারিস ইত্যাদি চরম ভাবাপন্ন শহরগুলো রোডসাইড ক্যাফে দিয়ে ভরা। মানুষ ওখানেই গিয়ে বসে বিকেল বেলা। ঢাকায় কি আমরা পারি না প্যারিস আদলে রোড সাইড ক্যাফে করতে? বনানী ১১ নম্বর কিংবা মালিবাগ ইত্যাদি জায়গায় একটু ভালোভাবে ট্রাফিক/ফুটপাথ ম্যানেজ করলে ওখানে ঢাকাবাসীর একটা সেইফ যাবার জায়গা হয়। এই শহরের মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে এই শহরগুলোই রক্ষা করতে। পুনরুদ্ধার করতে। নতুন করে গড়ে তুলতে। চিটাগংয়ের নাগরিকরা আন্দোলন করে সিআরবির সবুজ পাহাড়ী চত্বর ধ্বংসের পরিকল্পনা বানচাল করে দিয়েছেন। ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা ইত্যাদি শহরের অধবাসীদেরই এগিয়ে আসতে হবে তাঁদের শহর পুনরুদ্ধারে। মাঝে মাঝে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমীক্ষা চোখে পরে। ঢাকা নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে অবসবাসযোগ্য শহর। ঢাকা আমার প্রিয় শহর। পৃথিবীর সবচেয়ে অবসবাসযোগ্য শহর হলেও ঢাকা/চট্টগ্রাম ইত্যাদি আমার প্রিয় শহর হয়েই থাকবে আজীবন। লেখক: রুমি আহমেদ খান, এমডি এফসিসিপি, ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস অস্টিন ডেল মেডিকেল স্কুল এর অধ্যাপক