জাহাজবাড়ি বা শেরেখাজা : ভাইয়া বনাম বাবা?
আনোয়ার পারভেজ হালিম
[১] আশির শেষ আর নব্বইয়ের দশকের শুরুতে তিনি ছিলেন বেশ আলোচিত ব্যক্তি। নিজেকে দাবি করতেন ভবিষ্যৎ বক্তা। সমকালীন রাজনীতি, সরকার, দেশ নিয়ে তাঁর সেই ভবিষ্যৎ বাণী কোনো কোনো দৈনিকে ছাপা হতো। আঞ্চলিক রাজনীতি, এমনকি ভূ-রাজনৈতবক বিষয়েও কথা বলতেন। তাঁর কাছে এটা ছিলো জিগজাগ খেলার মতো। কৌশলটা চমৎকার। খেলার সূত্রটা রপ্ত করে ফেলেছিলাম। তবে প্র্যাক্টিস করিনি, করা হয়নি। ইচ্ছেও নেই। মূলত তাঁকে উদঘাটনের গোপন বাসনা নিয়েই তাঁর বাড়িতে যাতায়াত শুরু করেছিলাম। বহু জেনারেল, তারকা রাজনীতিক, ছাত্রনেতা, বড় বড় ব্যবসায়ী, মাস্তান, দাগী সন্ত্রাসী, বিভিন্ন পেশা-নেশার, দেশি-বিদেশি, সাদাকালো নানান জাতের মানুষের মেলা দেখেছি তাঁর আঙ্গিনায়। আমরা তাঁকে ডাকতাম ভাইয়া। তিনি আমাদের সবাইকে ডাকতেন বাবা। ঘরে সব সময় পরতেন লুঙ্গি, গায়ে চাদর, মাথায় পাগড়িÑ সবই গেরুয়া রঙের। বাড়ির নিচ তলার পাকা ফ্লোরে খোদাই মিনি পুকুর, টলটলে পানির ওজুখানা। চারপাশের দেয়ালজুড়ে টানানো ছিল বিশাল বিশাল সাইজের বাঁধানো ফটো। সেসব ফটোতে বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, ভিভিআইপিসহ বিখ্যাতদের সঙ্গে তিনিও ছিলেন। এই তিনি হলেন আনোয়ারুল হক চৌধুরী ওরফে শেরে খাজা। নামের পরের অংশটি উপাধি, পেয়েছিলেন দিল্লির কোনো এক মাজার শরিফ থেকে (নামটি উহ্য রাখলাম)। প্রচলিত আছে, যে দেশের নাগরিকই হোন না কেন, বার্ষিক ওরশে যে যতো বেশি অঙ্কের টাকা/রুপি/ ডলার দান করবেন, দিল্লির সেই মাজারের গদিসীন পীর তাকে ততো বড় উপাধি দিতে কার্পণ্য করতেন না। এককথায় বলে রাখি, শেরে খাজা একসময় ছিলেন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী। চুয়াত্তরে বেবিফুডের সংকটকালে তাঁর ব্যবসার বড় ধরনের উত্থান ঘটে।
[২] এবার মূল কাহিনিতে আসা যাক। তখনো হাতে হাতে মোবাইলের চল শুরু হয়নি। একদিন বিকালে অফিসের ফোনে ভাইয়া বললেন, বাবা, একটা ঝামেলা হয়ে গেছে সন্ধ্যায় চলে আসো। খটকা লাগলো, তাঁর মতো লোকের ঝামেলা। সন্ধ্যায় গিয়ে দেখি অনেকে হাজির। অভি এসেছেন তাঁর বডিগার্ড গুড্ডুকে নিয়ে। সিনিয়র সাংবাদিক আহমেদ নূরে আলম ভাইও উপস্থিত। আরও অনেকে ছিলেন, এখন সবার নাম মনে পড়ছে না। ঝামেলার কারণটা এরকমÑ শেরে খাজার বাড়ির পরের (পূর্ব পাশে লেকঘেঁষা) বাড়িটিতে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ছিল। ওই স্কুলের প্রিন্সিপাল তৎকালীন ধর্ম সচিবের স্ত্রী। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শেরেখাজার বাড়ির গেটে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের প্রাইভেটকারের এমন জট লেগে যেতো যে, তিনি নিজের গাড়ি নিয়ে যখন তখন বের হতে পারেন না। এটা নিত্যদিনের ঘটনা, বিষয়টি ধৈর্যের বাইরে চলে গিয়েছিল। ওইদিন সকালে এ নিয়ে স্কুলের প্রিন্সিপালের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া হয়েছে। যেহেতু ছাত্রছাত্রী, অভিভাবকরা প্রিন্সিপালের পক্ষে, স্বামী আমলা, তাই তার দল ভারি। শেরে খাজাও ছেড়ে দেওয়ার লোক না। এর একটা শক্ত জবাব দিতে হবে। মামলা করার সিদ্ধান্ত হলো। জরুরি কাজ আছে বলে গুড্ডুকে নিয়ে অভি চলে গেলেন। শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক নূরে আলম ভাই বললেন, চলো। তাঁর সঙ্গে ৬ নম্বর রোডে ধানমন্ডি থানায় গেলাম। মামলার সাক্ষী হলাম। পরে মামলাটা চলেনি। কারণ, অন্যায়টা মূলত স্কুল কর্তৃপক্ষের। ওসির মধ্যস্থতায় প্রিন্সিপাল শেরে খাজার বাড়িতে এসে আপস করেছিলেন। এর আরেকটা কারণও ছিল, শেরে খাজার হাত অনেক লম্বা। আমলা স্বামীর চাকরির সমস্যা হতে পারে, সেটাও প্রিন্সিপালের বিবেচনায় ছিল।
[৩] জাহাজ বাড়ির নেপথ্যে। ৫ এ সড়কের লেক সংলগ্ন লম্বালম্বি প্লটটিতে রাস্তা ঘেঁষে বাড়ি করেন শেরে খাজা। নাম দেন চিশতিয়া প্যালেস। কিছু দিন পর দেখা গেলো- বাড়ির পেছন দিকে নিজের জায়গা ছাড়িয়ে লেকের জায়গাসহ পাড় বাঁধাই করে ফেলেছেন। লেকে নামার সিঁড়িও তৈরি করেছেন, যা সম্পূর্ণ অবৈধ। সন্ধ্যার পর সেই পাকা চত্বরে বসে অনেকদিন আমরাও আড্ডা দিয়েছি। শেরে খাজা মানে আমাদের গণভাইয়া দাবি করতেন বাড়িটির স্থপতি তিনি নিজেই। তবে কথিত আছে, এটি লন্ডনের একটি বাড়ির হবহু নকল। ভাইয়ার অনুমতি ছাড়া এ বাড়িতে কেউ ঢুকতে পারতো না। গেটে সব সময় তালা মারা থাকতো। ভেতরে দাড়োয়ান স্টান্ডবাই অ্যালার্ট থাকতো। যেকোনও কারণেই হোক, একটা সময় ওপর মহলের সঙ্গে ভাইয়ার কানেকশনগুলো কিছুটা লুজ হয়ে যায়। সেই সুযোগে সিটি করপোরেশন লেক উন্নয়নের অংশ হিসেবে ভাইয়ার দখল করা অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দেয় এবং ওয়াকওয়ে নির্মাণ করে। তিনি জোর তদবির করেও শেষ রক্ষা করতে পারেননি। ওয়াকওয়ে তৈরির পর লোক চলাচলের কারণে বাড়িটি অরক্ষিত হয়ে পড়ে। যেহেতু বাড়িটির ডিজাইন লম্বালম্বি, তাই শেরে খাজা বুদ্ধি করে লেকপাড়ের দিকের দেয়ালটি এমনভাবে বানালেন যে, দূর থেকে দেখলে বাড়িটিকে জাহাজের মতোই মনে হতো। বিশেষ করে বাড়ির সামনের দিকের বড় টাওয়ারটিকে মনে হতো জাহাজের মাস্তুল। যদিও শেরে খাজার ভাষ্য- তিনি বাড়ির মূল ডিজাইনে পরিকল্পিতভাবেই তিন টাওয়ার তৈরি করে নাম দিয়েছিলেন- আলিফ, লাম ও মিম। এক পর্যায়ে সেটি জাহাজবাড়ি নামেই পরিচিতি পায়। তবে নির্মাণ ত্রুটির কারণে শেষের দিকে বর্ষা এলে তিনতলা বাড়িটির ছাদ চুঁইয়ে পানি পড়তো, যা ভেঙে সংস্কার করাও অম্ভব ছিল।
[৪] শেরে খাজার মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে রুবেল, মেয়ে সাদিয়া এবং স্ত্রী রেহানা চৌধুরী মিলে বাড়িটি ডেভেলপারকে দেন। জাহাজবাড়ির সেই জায়গায় এখন বহুতল আধুনিক ভবন। প্রসঙ্গত, শেরে খাজার একমাত্র ছেলে রুবেল চৌধুরী পড়াশোনা করেছে ব্রিটিশ রয়েল মেরিন অ্যাকাডেমিতে। বিয়ে করেছে নেপালের বিখ্যাত কৈরালা পরিবারে। সুজাতা কৈরালা তার শাশুড়ি। রুবেলের একমাত্র বোন সাদিয়ার বিয়ে হয়েছিল বরিশালের সাবেক এক এমপির ছেলের সঙ্গে। ওরা ভাইবোন দুজনই অমায়িক। রুবেলের সঙ্গে ২০১০/১১ সালের দিকে যখন দেখা হয়, তখনই বলেছিল, বাড়িটি ডেভেলপারকে দেওয়ার কথা চলছে। ওর সঙ্গে ২০১৪/১৫ এর পর আর দেখা হয়নি। ভাইয়ার বাড়িতে আমাদের জন্য নানা ধরনের নাস্তার আয়োজন থাকতো। সঙ্গে কমন আইটেম হিসেবে থাকতো ভাবির হাতে তৈরি বিফ টিকিয়া, যা দারুণ সুস্বাদু ছিল। [একটা উদ্দশ্য নিয়েই গিয়েছিলাম এবং কাছ থেকে অনেককিছু দেখেছি, তাঁর সম্পর্কে জেনেছিও অনেক। যা একদিনে বলে শেষ করা যাবে না। তবে সব কথা সব সময় না বলাই শ্রেয়]। ফেসবুকে ৪-৩-২৪ প্রকাশিত হয়েছে।