ফরিদা আখতার
বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও দিনের বিশেষ রং মেনে চলার রীতি চলছে অনেকদিন ধরেই। শোকের জন্য কালো, শান্তির জন্যে সাদা, বসন্তের রং হলুদ, বিপ্লব ও প্রতিবাদের রং লাল – এসব অনেক রংয়ের ব্যবহার আছে যার অর্থ আপনাতেই প্রকাশিত হয়। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের রং “বেগুনি”। এটা নারীর সংগ্রামের রং। শোষিত মানুষের লাল রক্ত জমাট বেঁধে কষ্টে বেগুনি রং ধারণ করে। নারী অধিকারের প্রশ্ন এই কষ্ট এবং ক্ষত থেকে মুক্তির জন্যেই। তাই বেগুনি। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এই রংয়ের শাড়ী পরে উৎসব নয়, নারীর সংগ্রামের কথা স্মরণ করে তাদের অবদান সমাজে তুলে ধরার কাজ করছে সকলে। হোক সে বছরে একদিনই, তবুও সেইদিনে পত্রিকার শিরোনাম হওয়া, বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হওয়া জরুরি, বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন জরুরি। জানুক সকলে নারী দিবস বলে কিছু আছে।
নারীবাদের এই বেগুনি রং নির্ধারিত হয়েছিল ১৯০৮ সালে; নারী সমতার রং ছিল তিনটি, সবুজ, সাদা এবং বেগুনি, যুক্তরাজ্যে নারীর সামাজিক এবং রাজনৈতিক ইউনিয়ন এই রং ব্যবহার শুরু করেছিল। নারীর প্রতি ন্যায্য বিচার, মর্যাদার দাবি ছিল প্রধান। নারীর ভোটের অধিকার ছিল না, সেই ভোটের অধিকার নিয়ে লড়েছিলেন যুক্তরাজ্যের নারী। ঊসসবষরহব চবঃযরপশ-খধৎিবহপব (১৮৬৭-১৯৫৪) এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অন্য একটি তথ্য হচ্ছে ১৯১১ সালের ২৫ মে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে একটি শার্ট ওয়েইস্ট তৈরীর কারখানার আগুনে পুড়ে ১২৩ নারী শ্রমিক নিহত হয়েছিলেন। তাদের কারখানায় তালাবদ্ধ্ব করে রাখা হোত যেন তারা বের হতে না পারে। তারা যে কাপড় সেলাই করতো সেগুলোর রং ছিল বেগুনি। তাই আগুনের ধোঁয়ার রংটাও হয়ে গিয়েছিল বেগুনি।
কাজেই এই বেগুনি রং দুটি গুরুত্বপুর্ণ আন্দোলনকে প্রতিনিধিত্ব করে। এক, ভোটের অধিকার বা বলা যায় নারী রাজনৈতিক অধিকার; দুই, শ্রমিক নারীর অধিকার।
আমরা ভোটের অধিকার পেয়েছি কিন্তু প্রয়োগ করতে পারি না। এর চেয়ে মারাত্মক অধিকারহরণ আর কি হতে পারে? আমরা বেগুনি কাপড় পরছি ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েই। কী আনন্দ। আমাদের দেশের সংসদে যারা বসেন, তাদের আমরা নির্বাচন করতে পারি না। সংসদে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষিত আছে, সেটাও নারীদের হাতে নাই। এই আসন হয়ে গেছে ক্ষমতার দাস! যে দিকে হেলতে বলবে সেই দিকে হেলবে; তারা শুধু টেবিল চাপড়ে সম্মতি জানাবে। ধিক্কার জানাই এই নারী আসনকে।
আমাদের কারখানাগুলোতে এখনও আগুন লাগে। নারী শ্রমিকরা মরে যায়, পত্রিকার শিরোনাম হয় কিছুদিন। তারপর সব নরমাল। তারা মুজুরির দাবী করলে দমনপীড়ন করা হয়।
আর নারীর প্রতি বিশেষ দরদ দেখাতে এসে বিভিন্ন কোম্পানি বেগুনি রংকে গোলাপি বানাতেও ছাড়েন না। গোলাপি রং নারীকে কামল মতি রাখার রং, কোন সংগ্রামের রং নয়। তাই গোলাপি নয়, বেগুনি হচ্ছে নারীদের সংগ্রামের রং। গোলাপি রংয়ে বিভ্রান্ত হবেন না। লেখক : নারী ও মানবাধীকার অধিকার রক্ষা নেত্রী।