উন্নয়ন চিন্তায় প্রতিবন্ধকতা ও উন্নয়ন প্রকল্পে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ
বিরুপক্ষ পল : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন শিক্ষাবিদ নিয়োগ করছে। নিয়োগ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ঘানাইয়ান জর্জ আগি অর্থনীতি বিভাগের কর্মসংস্থান সেমিনারে বক্তৃতা করেন। জর্জ তার ডক্টরেটের জন্য কীভাবে একটি উৎপাদন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা যায় তা অধ্যয়ন করেছিলেন। লিঙ্গ ও বর্ণের বৈচিত্র্য কীভাবে উৎপাদনে ভারসাম্য আনতে পারে। জর্জ এমন একটি বিমানবন্দরের উদাহরণ ব্যবহার করেছেন যেখানে অন্য সব কাউন্টার খারাপভাবে কাজ করে ও ফ্লাইট বিলম্ব যাত্রীদের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দেয়- যদি সেখানে একটি ধীর কাউন্টারও থাকে। ঢাকা বিমানবন্দরের সঙ্গে এটিকে সংযুক্ত করার উদাহরণে আমি কেঁপে উঠি যেখানে বিদেশ ভ্রমণের সময় যাত্রীদের অপ্রয়োজনীয় সারি ও বাড়িতে পৌঁছানোর সময় লাগেজের জন্য অপেক্ষা করা একটি নিয়মিত ঘটনা। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ অবশ্যই এগিয়েছে, তবে কিছু বাধার কারণে এই অগ্রগতির সুবিধাগুলো ব্যাপকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। নতুন সরকারের উচিত এই প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করা ও তাদের দিকে সরাসরি পরিকল্পিত সংস্থান দেওয়া। উন্নয়নের জন্য তহবিল পরিমিত হলে ক্ষতি নেই। কর থেকে জিডিপি অনুপাত ১২-১৪ শতাংশ না হওয়া পর্যন্ত একটি পরিমিত উন্নয়ন বাজেট প্রয়োজন।
বড় উদ্যোগের কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য ছোটখাটো বাধা দূর করার সময় এসেছে, যা ঋণ পরিশোধকে সহজ করে তুলবে। বিশাল প্রকল্পের রিটার্ন ততোক্ষণ পর্যন্ত উঠবে না। উপরন্তু, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো বিশাল প্রকল্পগুলো ভবিষ্যতে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এই শরতে ঢাকায় গিয়েছিলাম। ঢাকা এয়ারপোর্টে আসার পর মোহাম্মদপুরে বসবাসকারী আমার ভাইকে ফোন করলাম। বিমানবন্দর থেকে মোহাম্মদপুর টাউন হলে গাড়ি আসতে দেড় ঘণ্টা লেগেছিলো, তাও ফার্মগেট-এয়ারপোর্ট এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করে। এমনকি এক্সপ্রেসওয়ে না থাকলে একই বা কম সময় লাগতো। তাহলে প্রশ্ন আসে: এক্সপ্রেসওয়ের সুবিধা কী? এটি নির্দেশ করে যে প্রকল্পে একটি বিভ্রাট বা বাধা রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, এটি একটি বড় বিলে সংযোগ সড়ক ছাড়া সেতু নির্মাণের একই পুরানো গল্প। এখন মেগা উন্নয়নের সময় নয় বরং যেগুলো ঘটেছে সেগুলোর সমন্বয় নিশ্চিত করা প্ররয়াজন। এক্সপ্রেসওয়ের প্রবেশ ও প্রস্থান চ্যানেলগুলোকে দ্রুততর করার জন্য ছোট সহযোগিতামূলক প্রকল্প গ্রহণ করা বিচক্ষণতার লক্ষণ। তা না হলে হার্টের উচ্চ রক্তচাপের শিরাগুলো ফেটে যাবে।
দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলে আমার শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার মহাসড়কটি আরও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ডিজাইন করা হয়েছে। একটি বাজার কাছাকাছি হলে এটি রাস্তার উপরে উঠে যায়। ধীরগতির গাড়ির জন্য এর পাশে একটি গৌণ রুট রয়েছে, যা বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয়। তবে ঢাকা থেকে নালিতাবাড়ী যাওয়ার পথে আমাকে নির্যাতন করা হয়। গাজীপুর ও ময়মনসিংহকে সংযোগকারী মহাসড়ক নির্মাণে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। আমার ধারণা ছিলো না যে এটি শেষ পর্যন্ত পার্কিং লট, গ্রামের বাজার, দোকানের বারান্দা, রিকশা ও নৌকার পথ বা যাত্রী তোলার জন্য লোকাল বাসের একটি হাব হয়ে উঠবে। ময়মনসিংহ শহরে ঢোকার পর আসে আরেক যন্ত্রণা। কোনো প্রশাসন আছে বলে মনে হয় না। অন্তত আগামী দুই বাজেটে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাজ হওয়া উচিত এসব ‘ব্লক অপসারণ করা।
জর্জ আসার আগে ওয়েন্ডজ ওয়াং, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন চীনা চাকরির আবেদনকারী; যিনি তার পিএইচডি করার জন্য ভারতের আমলাতান্ত্রিক পরিচালিত গ্রামীণ প্রকল্পগুলো অধ্যয়ন করেছিলেন। উপরন্তু, ওয়াং হার্ভার্ডস কেনেডজ স্কুল অফ পাবলিক পলিসিতে উচ্চাকাক্সক্ষী আমলাদের একটি শ্রেণিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন থেকেই তিনি এই বিষয়ে আগ্রহ তৈরি করেছেন। তিনি প্রমাণ দিয়েছেন যে কীভাবে আরও নিরীক্ষার ফলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির জন্য উচ্চ উৎপাদনশীলতা ও কম খরচ হয়। ওং যখন ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলেন তখন আমি বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রসঙ্গ তুলেছিলাম। বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট বিষয়ে তার সম্পূর্ণ ধারণার অভাব ছিলো কিন্তু তার শিকাগো-ভিত্তিক প্রশিক্ষক মাইকেল ক্রেমার দ্বারা অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুপরিচিত ‘ও-রিং’ তত্ত্ব উল্লেখ করেছেন। যিনি ২০১৯ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন। ক্রেমারের উন্নয়ন তত্ত্বের ভিত্তি ছিলো ব্যর্থতা। মার্কিন মহাকাশযান চ্যালেঞ্জার ১৯৮৬ সালের জানুয়ারিতে উৎক্ষেপণের মাত্র ৭৩ সেকেন্ডের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যায়। দুর্ঘটনাটি একটি ও-আকৃতির রিং বা বৃত্তের ব্যর্থতার কারণে ঘটেছিলো (যা একটি গ্যাসকেট নামে পরিচিত)। ক্রেমার এটি থেকে শিখেছিলেন ও ১৯৯৩ সালে তার ‘ও-রিং’ তত্ত্ব উপস্থাপন করেন যা পড়ে যে কোনও জটিল ও বড় প্রকল্প এমনকি একটি উপাদানের অভাব বা এর ত্রুটিপূর্ণ অবস্থানের কারণে ব্যর্থ হতে পারে।
এটি উন্নয়নের অন্তরায়। যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে সমান গুরুত্ব দিয়ে করতে হয়। অন্যথায়, প্রকল্প নিজেই অর্থহীন হয়ে যায়। ১০টি প্রকল্পে ১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার পরিবর্তে সাতটি প্রকল্প শুরু করা উচিত ও বাকি ৩ মিলিয়ন ডলার অবশ্যই সেই সাতটির সুরক্ষা, সমাপ্তির জন্য সরবরাহ করা উচিত। পদ্মা সেতু প্রকল্পে শুধু সেতু নির্মাণের চেয়ে আরও অনেক কিছু আছে। এতে এর দুই পাশে নতুন রাস্তা নির্মাণ ও সেতু রক্ষণাবেক্ষণের মূল্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আমাদের উন্নয়ন চিন্তায় প্রতিবন্ধকতা দূর করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, বরং অনেক সময় বাড়তি আয়ের স্বার্থে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। তবে উন্নয়নের এসব বাধা চিহ্নিত করে বাজেট ও নির্মাণ কাজ পরিচালনা করলে উন্নয়নের সুফল নিশ্চিত করা সম্ভব। যা এখন দেখার সময় এসেছে।
লেখক : নিউইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : ডেইলি সান