সিনেমা পাড়া, সিনেমার জগৎ নয় এবং খিস্তিখেউড়
য়দ ইশতিয়াক রেজা
আমি সুযোগ পেলেই সিনেমা দেখি বলতে পারেন। সিনেমার পাগল আমি। নেট্রফ্লিক্স, ইউটিউবে সময় পেলেই সিনেমা দেখি। হলে গিয়ে দেখি। বাংলা সিনেমা যে একেবারে ভালো হয় না তা কিন্তু না। তবে বাংলাদেশের সিনেমা জগতটা তো আসলে আর সেরকম নেই। ভালো ছবি হয় না। তাই দেখার কিছু নেই। কিন্তু বাংলাদেশে একটা সিনেমা পাড়া আছে। এই পাড়ায় সিনেমা হয় না, নান্দনিক কিছু খুঁজে পাবেন না। কিন্তু ঝগড়া ফ্যাসাদ আছে এবং প্রায় সময় আমরা খুবই প্রকাশ্যে দেখতে পাই তাদের ভেতরকার এসব কাহিনি।
সম্প্রতি জায়েদ খানকে দেখলাম শিল্পী সমিতি বহিষ্কার করেছে এবং সেটা করেছে একটা বনভোজনে গিয়ে। সেখানে নাকি তাদের বাৎসরিক সাধারণ সভা হয়েছে এবং কে করেছেন, চিত্র নায়িকা নিপুন। নিপুন এখন চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেছেন, জায়েদ খান ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা জনের নামে, বিশেষ করে নিপুনের নামে মিথ্যাচার কুরুচিপূর্ণ কথা সাংবাদিকদের কাছে প্রচার করে বেড়াচ্ছেন। অন্যদিকে জায়েদ খান বলেছেন, তিনি তিনবার নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, শিল্পী সমিতির পিকনিকে তাকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি। এমনকি ফোন দিয়েও কেউ বলেনি যাওয়ার জন্য। বহিষ্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, তারা অত্যন্ত সংকীর্ণ মানসিকতার মানুষ। প্রশ্ন হলো জায়েদ খান তো নায়ক। আপনারা তার কোনো ছবি দেখেছেন কিনা জানি না। কিন্তু আমি তার কোনো সিনেমা দেখিনি। সিনেমাবিহীন এই নায়ককে সাংঘাতিকভাবে সোশ্যাল মিডিয়াতে নানাভাবে তার উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই। তেমনি নায়িকা নিপুনেরও সর্বশেষ কোন সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে জানি না। ইলিয়াস কাঞ্চন একজন স্বনামধন্য নায়ক, তার সিনেসা একসময় অনেক মুক্তি পেয়েছে, এখন তিনি তার জগৎ নিয়ে ব্যস্ত। বিশেষ করে নিরাপদ সড়ক চাই নিয়ে।
একটা সময় ছিলো যখন সকল শ্রেণি পেশার সকল মানুষই সিনেমা হলে যেতো। কিন্তু কয়েক দশক ধরে চলচ্চিত্রে ধস নেমেছে। দর্শক আছে। কিন্তু তারা হল সিনেমামুখি হচ্ছে না। ঘরে বসে তারা বিকল্প পথে সিনেমা দেখছে। কেউ বলছেন হলের দুরবস্থা, সিনেমার মান নেই, দর্শকদের চাহিদা না বুঝতে পারা, শিল্পীদের নিষ্ঠার অভার। ভালো সিনেমা প্রকাশ হলেও দর্শক তা গ্রহণ করছে না। শিল্পী সমিতির নির্বাচনকে ঘিরে যে গালাগালি, ফ্যাসাদ খেলাম আমরা। সবাই সবাইকে গালাগালি করছে। আক্রমণের ভাষাও খুব অবাক করার মতো। আমাদের চলচ্চিত্র নিয়ে আমরা বলতে চাই, আসলে এটা একটা পাড়া। আজব শ্রেণিতে ভরে গেছে এই পাড়া। শিল্প কাকে বলে, সিনেমা কাকে বলে এই উদ্ভট ভাবনার লোকগুলোই ঠিক করছে। এখানে কোনো সুস্থতা আছে বলে দৃশ্যমান নেই।
আমরা জানি সবসময় বলাই হয় বস্তা পঁচা কাহিনি, দুর্বল নির্মাণ, সম্পাদনা, সবকিছু মিলিয়ে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, কোনো ভদ্রলোক আর পরিবার নিয়ে হলে সিনেমা দেখতে যায় না। ঘাম চিটচিটে শরীর নিয়ে কেউ সিনেমা দেখেন অপরিছন্ন হলগুলোতে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ব্যাপারটি হলো তারা এটা নিয়ে ভাবছে না। এই জগতটাকে কীভাবে আরও উন্নত করা যায়। এই হলগুলোর ইমেজটা যে খারাপ হয়ে গেলো। সেটা ফিরিয়ে আনা দরকার। হল একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এই ভাবনাটি তাদের মধ্যে নেই। ঢালিউড বলা হয় ঢাকাই সিনেমাকে। কিন্তু সিমেনার তো কোনো ছিটাফোঁটা নেই এখানে। কেবল আছে নোংরা রাজনীতি। কে কাকে বহিষ্কার করছে, কে কাকে হুমকি দিচ্ছে এসব ছাড়া কোনো গল্প নেই এই পাড়াটায়। আমরা দেখলাম শিল্পীসমিতির নির্বাচনে কতোজন কতোজনকে কতোকিছু বলছে, সবার ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে এবং সবাই চেষ্টা করছেন কে কাকে কতো অকথ্য ভাষায় আক্রমণ করছে। তাই বলি এটি সিনেমা পাড়া, এটা সিনেমার জগৎ নয়।
সে পাড়ায় যদি কেউ একজন যোগ্য ব্যক্তি যেতে চান, হাল ধরতে চান তখন তাদের প্রচেষ্টা থাকে কীভাবে তাকে সরানো যায়। এই যে প্রচেষ্টা এটি এমন এক জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে যে শুধু শত্রুতা দেখতে হয়। কোনো ধরনের গঠনমূলক আলোচনা সিমেনা নিয়ে তাদের কাছে শোনা যায় না। এফডিসিতে এখন স্টুডিও ভাড়া করে দেওয়া হয়। কারণ এফডিসি এখানে থাকছে না। এখানে মার্কেট হচ্ছে এবং ভেতরের পরিবেশ যে কী রকম হয়েছে তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। প্রতিবছর চলচ্চিত্র পুরস্কার দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী সেখানে যান। কিন্তু দুঃকজনক হলো এই জগৎটার পরিবেশ নিয়ে কেউ কিছু চিন্তা করছে না। সিনেমা যে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে সেটা নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। আমি জানি দেশে অনেক গুণী পরিচালক আছেন তারা চেষ্টা করছেন। তারা এই শিল্পী সমিতির, প্রযোজক সমিতির, পরিচালক সমিতির ঝগড়ার মধ্যে নেই। তারা তাদের মতো করে আলাদা কাজ করছেন, ভালো কাজ করছেন। তারা আবার এই জগতে আসতে চাইলে তাদের এই জগতে আসতে দেওয়া হবে না। অনেক সীমাবদ্ধ নিয়েও বলতে হবে শাকিব খান বাংলা চলচিত্রের অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন নায়ক। তিনি একমাত্র হ্যাবি ওয়েট বাংলা তারকা।
সিনেমার আরেকটা নামও উচ্চারিত হয় না। আর একজন নায়কও নেই। তাহলে কী সিনেমা জগৎ এটা? শাকিব খান এখন ভারতে সিনেমা নিয়ে ব্যস্ত। বিদেশের বাজার তো দূরের কথা, দেশের বাজারেই প্রোডাক্ট হিসেবে এফডিসির সিনেমা এখন আর নেই। ভালো সিনেমার চাহিদা কিন্তু দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু যোগান দিতে বিমুখ এই শ্রেণিটা। তাদের যোগ্য ব্যক্তিদের ধরে রাখার চেষ্টাও নেই। এই যে আমরা শিল্পী সমিতির নির্বাচনে গত কয়েক বছরে দেখতে পাচ্ছি, একজন সিনিয়র পরিচালক আরেকজন পরিচালককে যা ইচ্ছে বলছেন খুব দম্ভ করে। সেগুলো আবার মিডিয়াতে প্রচারও করছে। এতে প্রত্যক্ষ হলগুলোর ক্ষতি হয়। পরোক্ষ ক্ষতিও কিন্তু অনেক। যারা মানসম্মত সিনেমা তৈরি করতে চাচ্ছে তারা আর আসছে না। এতে করে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পড়ে আছে ছোট নদীতে। বড় নদী যদি পার না হতে পারে তাহলে বাংলা সিনেমার ভবিষ্যৎ একেবারেই অনিশ্চিত। এখানে শিক্ষিত রুচিশীল লোকদের আসতে হবে। তাদের যদি আসতে দেওয়া না হয় তাহলে তাদের এই সমস্ত ঝগড়া আমাদের দেখতে হবে।
পরিচিতি : সিনিয়র সাংবাদিক। সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ফেসবুক পেজের ভিডিও কনটেন্ট থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন মাসুদ হাসান