নতুন পাঠ্যক্রম স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে একধাপ এগিয়ে
ড. মো. আকতারুজ্জামান : ২০৪১ সালে একটি উন্নত দেশ হওয়ার জন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার আরও উন্নতি প্রয়োজন। এর ভিত্তি মজবুত করতে হবে। এটি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে নতুন পাঠ্যক্রম প্রণয়নের মাধ্যমে শুরু করা হয়েছে। এখন দেখা যাক উন্নত দেশগুলোতে কি ধরনের শিক্ষা প্রচলিত আছে। ২০২২-২৩ সালে, আমি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ফেলোশিপ চলাকালীন আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দক্ষ জনশক্তি উন্নয়নে কাজ করেছি। ধারণা ছিলো যে তারা আমাদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে নিয়ে যাবে। আশ্চর্যজনকভাবে, ঘটনাটি এমন ছিলো না, বেশিরভাগই তারা আমাদের বিভিন্ন উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলো। সেখানে আমি ৮/৯/১০ ক্লাসের ছাত্রদের সঙ্গে অর্থপূর্ণ সহযোগিতামূলক প্রকল্প করতে দেখেছি। তারা রোট মেমোরাইজেশনের চেয়ে প্রকল্প ভিত্তিক শিক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। নতুন কারিকুলামে এই ধরনের প্রকল্প-ভিত্তিক সহযোগিতামূলক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
আমরা একটি স্বনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে চাই কিন্তু প্রচলিত মানসিকতা থেকে বের হতে চাই না। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে নতুন পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। চারটি কবিতা ও দশটি প্রবন্ধ মুখস্থ করা ও পরীক্ষায় লেখার মতো মুখস্থকরণের উপর ভিত্তি করে আমরা বছরের পর বছর ধরে যে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হয়েছি তা উন্নত বিশ্ব দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যাগ করেছে। পরিবর্তে, তারা সহযোগিতামূলক ও প্রকল্প-ভিত্তিক শিক্ষার উপর জোর দেয়। গুগল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, চ্যাটজিপিটির যুগে আমাদের অবশ্যই প্রামাণিক মূল্যায়নের দিকে ঝুঁকতে হবে। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে যদি একটি পার্থক্য থাকে, তাহলে সেটা অবশ্যই চাকরি নিয়ে আমাদের দেরি করে চিন্তা করা। আমরা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করার আগে চাকরির কথা ভাবিনা বা আমরা এর জন্য সুযোগ তৈরি করতে পারি না। উন্নত দেশগুলোতে, উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮-১২ গ্রেডের শিক্ষার্থীরা নিয়মিত কোর্সের সঙ্গে ২-৩টি বৃত্তিমূলক দক্ষতা সম্পন্ন করে, যেমন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট, অটোমোবাইল, ইলেকট্রিশিয়ান, প্লাম্বিং, নার্সিং বা অন্য কিছু। এমন দক্ষতার প্রয়োজন যা বর্তমান ও চাকরিতে নিয়োগযোগ্য। এভাবে চিন্তা করলে একদিকে যেমন রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের কর্মদক্ষতা ও বেতন বাড়বে (অধিকাংশ উচ্চ বিদ্যালয় বা কলেজে পড়ার সময় বিদেশে চলে যায়) তেমনি দেশে দক্ষ জনশক্তির একটি বড় পুল তৈরি করবে। গড় নাগরিক ৫-১০ বছরের কর্মঘণ্টা হারায় যদি তারা তার চেয়ে বেশি বয়সে কাজ শুরু করে।
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এমপি যথার্থই বলেছেন, প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসতে পারে। স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে হলে প্রচলিত শিক্ষায় কারিগরি উপাদান যুক্ত করতে হবে। এর মানে এই যে আপনাকে সারাদিন লোহা, হার্ডওয়্যার ও হাতুড়ি দিয়ে কাজ করতে হবে। যেকোনো ভাষা শেখা একটি দক্ষতা, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখা একটি দক্ষতা, রান্না শেখা একটি দক্ষতা। আমাদের এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যা দক্ষ ও চাহিদাসম্পন্ন জনশক্তি তৈরি করে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র চাকরি পাওয়া নয়। যে শিক্ষা শুধু দিনে দুবেলা খাওয়াতে পারে তা অর্থহীন। নতুন পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে একটি পরিবর্তন শুরু হবে যা দেশ ও জাতি প্রত্যাশা করে। একটি ক্লাসে ১০০ জন ছাত্রের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার বা অফিসার হয় ২০-৩০ জন, বাকি ৭০-৮০ জন কোথায় যাবে? অনেক ক্ষেত্রে চাকরির শ্রেণী সরাসরি ফলাফলের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। কেউ কেউ ভারতের উদাহরণ দেন- তাদের কতোজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইটি প্রফেশনাল বিদেশে যায় আর কতো সাধারণ মানুষ বিদেশে যায়। আপনি যদি একটু হিসাব করেন, আপনি দেখতে পাবেন যে এটি ১:৪ এর মতো। ক্লাসের শীর্ষ ২০-৩০ জনের চেয়ে ৭০-৮০ জন শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করা ভালো। এই দুষ্টুচক্রের মতো শিক্ষিত বেকার বা বেকার শিক্ষিতরা সাধারণ শিক্ষা নিয়ে আমাদের পরিত্রাণ দিতে হবে। আমরা দেশ ও পরিবারের বোঝা হয়ে পড়ি কিন্তু তারপরও কারিগরি শিক্ষাকে আমরা বিবেচনা করি না। দেশের আয়ের প্রধান উৎস হলো গার্মেন্টস ও রেমিট্যান্স, তাই অফিসারের চেয়ে দক্ষ কর্মী হওয়া আমাদের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
একজন গাড়ি মেকানিক উন্নত দেশগুলোতে অনেক ক্ষেত্রে একজন অধ্যাপকের চেয়ে কম উপার্জন করেন না। তাদের সামাজিক মূল্যবোধের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই, এর অর্থ এই নয় যে কারো অধ্যাপক হওয়ার প্রয়োজন নেই। একজন প্রফেসর হওয়ার জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়, কিন্তু আপনি যদি ৬-১২ শ্রেণীতে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কিছু কারিগরি শিক্ষার প্রাথমিক ধারণা দেন, তাহলে বিদেশে একটি সার্টিফিকেট পেয়ে সহজেই একজন মেকানিক হয়ে উঠতে পারেন। অস্ট্রেলিয়ায় এমনই প্রথা রয়েছে। ইউরোপ বা আমেরিকায় একজন অটো মেকানিক গড়ে ৭-৮ হাজার ডলারের কম আয় করেন ও অনেক ক্ষেত্রে তাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া বিরল। প্রত্যেকের বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার দরকার নেই যা প্রায়শই আরও বেকারত্বের কারণ হয়। তাই একটি নতুন পাঠ্যক্রম একটি পরিবর্তনের সূচনা চিহ্নিত করতে পারে। সকল শিক্ষার্থীকে দ্বাদশ শ্রেণীর আগে কমপক্ষে দুটি বৃত্তিমূলক ট্রেড ও দুটি ভাষায় দক্ষ হতে হবে। উচ্চশিক্ষায় আগ্রহীদের জন্য স্নাতকের পাশাপাশি দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এক্ষেত্রে একাডেমিক ব্যাংক অফ ক্রেডিটস একটি খুব ভালো উদ্যোগ হতে পারে। এছাড়া সিঙ্গাপুর, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকার মতো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্ব প্রয়োজন। শিক্ষিত বেকারত্ব দেশ, সমাজ ও পরিবারের জন্য বোঝা। তাই দেশের চাহিদা ও বৈশ্বিক চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা গেলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি আগামী ১০ বছরে রেমিট্যান্স ৫-৭ গুণ বাড়তে পারে।
গত মাসে আমি আমার ছেলের জন্য একটি পড়ার টেবিল কিনেছি যে মেলবোর্নের একটি স্কুলে পড়াশোনা করছে। আমি একটি লাগানো টেবিল বা সর্বাধিক ২-৩ অংশ আশা করেছিলাম যা আমি সহজেই একত্রিত করতে পারি। কিন্তু বাস্তবতা ছিলো ভিন্ন। ৩০-৪০ টা পার্টস পেলাম। বড় ঝামেলায় পড়লাম তখন। তখন আমার ছেলে বললো, ‘চিন্তা করবেন না, আমি এটা করবো’। তাদের গ্রেড স্টেম শিক্ষা কোর্সে, পণ্য ডিজাইন শেখানো হয়েছিলো। এখন সে অষ্টম গ্রেডে ও রান্নার প্রযুক্তি কোর্সে অধ্যয়ন করছে। উন্নত দেশগুলোতে এই প্রথা। আমাদের দেশে যদি এমন হতো, তাহলে আমরা স্কুলের মানহানি করতাম। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের একটি প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে ‘আজ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশকারী ৬৫ শতাংশ শিশু অবশেষে সম্পূর্ণ নতুন চাকরিতে কাজ করবে যা এখনও বিদ্যমান নেই’। ভবিষ্যতের কাজগুলো হবে সেইগুলো যা মেশিন দ্বারা করা যাবে না। একই সময়ে, সৃজনশীল প্রচেষ্টা, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, বৃত্তিমূলক দক্ষতার মতো ক্ষেত্র যেখানে মানুষ মেশিনকে হারাতে পারে তা চাকরি সৃষ্টির জন্য উন্মুক্ত হবে। আমরা দেখছি কাজ ও শিক্ষার জগতগুলো বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমানভাবে একত্রিত হচ্ছে। শিক্ষাকে জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম হিসেবে না ভেবে, আমাদের সাধারণ শিক্ষা ও কর্মমুখী শিক্ষার একটি সমন্বিত পদ্ধতির দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। এটি নতুন জাতীয় পাঠ্যক্রমের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।
শিক্ষা একটি চলমান প্রক্রিয়া। কপিরাইট সমস্যা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, রীতিনীতি ও অন্যান্য কিছু ত্রুটি সম্পর্কে আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিলো আমাদের। কিন্তু পৃথিবীতে কোনো কিছুই ১০০ শতাংশ সঠিক শুরু হয় না, তাই যুগ যুগ ধরে পরিমার্জন ও পরিবর্ধন হয়ে আসছে। মানুষ সবসময় তাদের পরিচিত পথে হাঁটতে চায়, কঠিন পরিবর্তন সহজে মেনে নিতে চায় না। ৯০-এর দশকে যখন কম্পিউটার প্রথম দেশে এসেছিলো, তখন অনেকেই এটাকে ভালোভাবে নেয়নি, ঠিক যেমন এখন অনেকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সহজে গ্রহণ করে না (এআই) বা জেনারেটিভ এআই যেমন চ্যাটজিপিটি। তবে শীঘ্রই তারা জনগণের দৈনন্দিন কাজের অংশ হবে। লেখক : পাঠ্যক্রম, ডিজিটাল শিক্ষা ও সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : ডেইলি অবজার্ভার