দেশে দ্বিতীয় নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের জন্য জায়গায় নির্বাচন কি সঠিক হয়েছে?
কাজী এম. মুর্শেদ
দ্বিতীয় নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট রূপপুরে তৈরি হবে। গত কয়েকবছর বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ করা হয়েছিলো, সেটা মূলত সাগরপারে খোঁজা হয়েছিলো, একটা সময় বরগুনাকে ঠিক করা হয়। কিন্তু এখন সেটাও বদলে গেলো। আবারও রূপপুর। পদ্মা নদীর পারে পানির প্রয়োজনীয়তা মেটাবে সেটা হিসাব করে এখানেই করা হবে। আমি আপনাদের ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রি শেখাতে বসিনি। অমার নিজের কথা বলছি। যদি মনে হয় আমার যুক্তি গ্রহণযোগ্য না, তাহলে বিশ্বাস করতে বলছি না। অযথা তর্কেও যাবো না। রূপপুর করার পেছনে বড় একটা কারণ রাশিয়ান কোম্পানি তাদের সেটআপ তৈরি করে রেখেছে। আরেক এলাকায় তৈরি হলে নতুন করে সেটআপ হবে, এমনকি ফ্রান্স তাদের আগ্রহ দেখানোর জন্য এটা যেনো রাশিয়ার হাতে থাকে তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমার অনেক অনেক যুক্তি আছে, কোনটা আপনি নেবেন, আপনার উপর।
নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট করতে গেলে দুইটা জিনিস খুবই দরকার। এক. শিক্ষা, অন্য অর্থ। দুইটা দিকেই আমরা দুর্বল। মিনিমাম কয়েকটা শিক্ষার দরকার আছে। আমার জানামতে, বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এসব কোর্স পড়ায় না। যেমন ধরেন- রিয়্যাক্টর ফিজিক্স, রিয়্যাক্টর কেমিস্টি, থার্মাল হাইড্রোলিকস ইত্যাদি। এছাড়াও সম্যক জ্ঞান থাকতে হয় যেসব বিষয়ে তার কিছু পড়ানো হয়। যেমন জিওলোজি, হাইড্রো জিওলজি, সিসমোলজি, ইলেকট্রনিক ও মেকানিকাল ইন্জিনিয়ারিং, মেটালার্জি, শিল্ডিং, রেডিয়েশন প্রটেকশন, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি। আমাদের হয়তো বিরাট সময় আমলাদের এসব কোর্স করিয়ে সময় পার করতে হবে, অথবা বিদেশিদের স্থায়ীভাবে রাখতে হবে। অর্থের ব্যাপারটা আর বলছি না, সেটা নেই বলেই রাশিয়া থেকে তিনগুণ খরচে তৈরি করতে হচ্ছে।
পত্রিকায় একটা লেখা দেখলাম এই নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট ড. ওয়াজেদ মিয়ার স্বপ্ন ছিলো। এই প্রকল্পের নাম তার নামে হওয়া উচিত। আসেন একটু ইতিহাস ঘুরে আসি। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পূর্ব-পশ্চিমের অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৬০ সালে এই প্রজেক্ট নেন, এটা মূলত রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমিত করার জন্য। জায়গা সেই রূপপুর, ১৪০ মেগাওয়াট পরিকল্পনা করে করা। পরবর্তী সময়ে এটা পাস হয় ১৯৬১ সালের মার্চে, এরপর কাজ শুরুর কথা হলেও করা যায়নি। পূর্ব পাকিস্তানিরা আইয়ুব শাহীর রাজনৈতিক চাল বুঝতে পেরে এটাকে শ্বেত হাতী বা হোয়াইট এলিফেন্ট নাম দেয়। আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানে টিভি চ্যানেল করেন, প্রথম কম্পিউটার আইবিএম ১৬২০ পূর্ব পাকিস্তানে করে, রেলস্টেশন করেন, টিএসসি করেন, অধুনা উত্তরার পরিকল্পনাও তার করা। সেকেন্ড ক্যাপিটাল হিসাবে সংসদভবন, প্রেসিডেন্ট বাসভবন হিসাবে বঙ্গভবন তার করা। এর কোনোটাই পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য করা না, এগুলো তার রাজনৈতিক চাল। ষাটের দশকের আন্দোলন প্রশমিত করার জন্য দেখানো যে কম গণতন্ত্র ও অধিক উন্নয়নই পূর্বের জন্য প্রয়োজন।
আইয়ুব খানের স্বপ্নের রূপপুর প্রজেক্ট যখন হয় এবং বাজেট পাস হয়, তখন ওয়াজেদ মিয়া ডক্টরেট করেননি, তিনি ছাত্র আন্দোলন করেন। এখন যদি শুনতে হয় এটা তার স্বপ্ন ছিলো এবং সরকারি এক উপাচার্য বিশাল আর্টিকেল লিখলেন, তখন মনে হয় বাংলাদেশ হলো সেই তৈলাক্ত বাঁশের গল্পের দেশ। যে আগে উঠবেন তিনি জয়ী হবেন। এবার একটু টেকনিকাল কথা বলি। নিউক্লিয়ার চুল্লী ১০০০ মেগাওয়াট ইলেকট্রিক বা গডব উৎপাদনে ৩৫০০ মেগাওয়াট থার্মাল বা গডঃয তাপ উৎপাদন করে। আমাদের বিজ্ঞান মন্ত্রী টার্মিনোলজিতে কিছু গোলমাল করে ফেলেছিলেন, তিনি বলেন, ১০০০ মেগাওয়াটে ২ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়, সেজন্য ৭০০০ মেগাওয়াটে ১৪ বিলিয়ন ডলার ঠিক আছে। ভারত কীভাবে ৩ বিলিয়ন ডলারে করেছে জানেন? কারণ গডব এবং গডঃয এর পার্থক্য তারা বোঝে। ২০০০ মেগাওয়াট সেই কারণে ৪ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে করতে পেরেছে। খরচের ব্যাপারে একটা কথা বলা হয়, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট তৈরিতে যা খরচ, এর মেইনটেইন করতে সমান খরচ। আমাদের ১৩ বিলিয়ন যে ২৬ বিলিয়ন হবে, শুধু অপেক্ষা করেন। তৈরি করছে রাশিয়া, তারা বলেছেন বর্জ্য তারা নিয়ে যাবে। আপনাদের কি ধারণা আছে এই বর্জ্য ঠাণ্ডা হতে ৬ বছর লাগে?
বিশ্বের বেশিরভাগ নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট সাগর পারে করা হয়। কারণ সহজ, ১০০০ গডব উৎপাদনে প্রতি মিনিটে ঠাণ্ডা রাখবার জন্য সেটা ইডজ বা চডজ বা গ্যাস কুলিং যাই হোক, প্রতি মিনিটে ৩ মিলিয়ন লিটার পানির দরকার পরে। পদ্মা নদীর পারে ৪ টা এমন ইউনিটে মিনিটে ১২ মিলিয়ন লিটার পানি কি দিতে পারবে? এটা হিসাব দেখেই বলছি, মিনিটে ১২ মিলিয়ন লিটার ঠাণ্ডা পানি যা তৈরি করবে গরম পানি। যদি একই পানি রিসাইকেল করা যেতো, তবে জাপানের ফুকুশিমা দুর্ঘটনা ঘটতো না। কিছু বিশেষজ্ঞ বলেছেন, একবার চাবি দিয়ে ছাড়লে ৫০-৬০ বছর চলবে। সমস্ত নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট একই নিয়মে চলে, প্রতি ১২ থেকে ১৮ মাস একটানা চালাবার পর ২ থেকে ৩ মাস বন্ধ থাকে। এই সময়টায় ডিফুয়েলিং, রিফুয়েলিং এবং কম্পোনেন্ট চেক করা ও রিপ্লেস করা সবই করা হয়।
ফ্রেঞ্চ একটা মুভ্যিতে দেখেছিলাম প্লান্টে আশেপাশে পায় ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার কোনো মানুষের বসতি থাকে না। নিউক্লিয়ার রেডিওঅ্যাক্টিভ বর্জ্য তিন ভাবে উৎপন্ন হয়Ñ কঠিন, তরল এবং বায়বীয়। আশেপাশের মাটি ফসলের অনুপোযোগী হয়ে পরে। যারা বসবাস করে তারা আক্রান্ত হয়। আমাদের সেই বিশাল জায়গা দেবার কি অবস্থা আছে? সময়ের ব্যাপারে বলি, সরকার ৬ থেকে ৮ বছরে তৈরি করবে। বাংলাদেশে এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট এসেসমেন্ট বা ঊওঅ করা হয়নি। এটা করা হলে এবং পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকলে বলি, একটা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট তৈরিতে ১৫ বছর লাগে, স্টাডির উপর নির্ভর করে কোন ধরনের রিএ্যাক্টর ব্যবহার করা হবে তা ঠিক করা হয়। উপরের বিষয়গুলো পরযালোচনা করলে বুঝবেন, আমার জ্ঞান এবং অর্থের অভাব আছে, তারপরও কেন সরকার এই প্রকল্প হাতে নিলো? কারণ সেই একই যা আইয়ুব শাহী করেছিলো, পুরোপুরি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সরকার প্রমাণ করতে পারে বাংলাদেশ যেকোনো মেগা প্রজেক্ট করে কারিগরিভাবে নিজেদের সক্ষমতা দেখাতে প্রস্তুত। অন্য কারণটা হলো অর্থনৈতিক। আমার জানামতে মন্ত্রী, আমলা, রাজনীতিবিদেরা রূপপুরের নামে আড়াই বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে রাশিয়া, অস্ট্রিয়া বেড়ানো হয়ে গেছে। যদিও রিএ্যাকটর কী এবং কোনটা প্রযোজ্য হবে সে সম্মন্ধে কোনো ধারণা নেই। যেখানে সুইজারল্যান্ড, জার্মান, ফ্রান্স বা জাপান একের পর এক নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট বন্ধ করছে, আমরা সেখানে ছুটে চলছি। লেখক: অর্থনেতিক বিশ্লেষক