জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি কি অর্থনৈতিক সংকটের সব সমস্যার সমাধান?
এবি সিদ্দিক
বাংলাদেশ সরকার রিজার্ভ ঘাটতির কারণে আইএমএফ’র কাছে থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে ৩০টি শর্ত মেনে নেয়। শর্তের মধ্যে রয়েছে জ্বালানির দাম সমন্বয় করা। অর্থাৎ জ্বালানির দাম বাড়নো এবং এখাত থেকে ভুর্তকি তুলে নেয়া। আর সেই শর্ত পালন করতে গিয়েই গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। আইএমএফের শর্তানুসারে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জ্বালানি পণ্যের দাম সমন্বয়ে করার কথা ছিল। আর সেই মানতে গিয়েই বিদ্যুৎ, গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ক্লাইমেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টেও (সিসিডিআর) জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতির মতো সংস্কারমূলক পদক্ষেপকে মধ্যম পর্যায়ের সম্ভাব্যতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আইএমএফ বলেছিল যে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে গ্যাস ও বিদ্যুতে দেয়া ভর্তুকির পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। ঋণ কর্মসূচি চলাকালে সময়ভিত্তিক জ্বালানির দাম সমন্বয় পদ্ধতি সরকারকে জ্বালানি পণ্যে কোনো ধরনের কাঠামোগত ভর্তুকি প্রদান না করার বিষয়ে সাহায্য করবে। সামাজিক সুরক্ষা জাল শক্তিশালী করার সময় সরকার ধাপে ধাপে গ্যাস ও বিদ্যুতের ভর্তুকি কমানোর উপায় খুঁজে বের করবে। বৈশ্বিক কমোডিটি মূল্যবৃদ্ধির প্রতিফলন হিসেবে গ্যাস ও বিদ্যুতে ভর্তুকির পরিমাণ ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপির শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হবে বলে প্রত্যাশা করা হয়েছিল যদিও তা কমে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০২১ সালের নভেম্বরে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ানোর পর গত বছরের নভেম্বরে এর দাম ৩৬ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। ২০২২ সালের জুনে প্রাকৃতিক গ্যাসের ট্যারিফ গড়ে ২৩ শতাংশ এবং বিদ্যুতের বাল্ক ট্যারিফ গত বছরের নভেম্বরে ২০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
সরকার দর নির্ধারণ পদ্ধতির মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে জ্বালানি পণ্যের দাম সমন্বয়ের পরিকল্পনা নিয়েছে। এর মাধ্যমে জ্বালানি পণ্যে কাঠামোগত ভর্তুকির পরিমাণ শূন্যে নেমে আসবে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে জ্বালানি খাতে সরকারের ভর্তুকির জন্য বাজেটের ওপর চাপ কমবে এবং জ্বালানির আরো বেশি সাশ্রয়ী ব্যবহার উৎসাহিত করবে। এছাড়া বৈশ্বিক পর্যায়ে পরবর্তী মূল্যবৃদ্ধি ব্যতীত আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি চলাকালে সরকার এসব ভর্তুকির পরিমাণ আর বাড়াবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং সামাজিক সুরক্ষা স্কিম বিস্তৃত করার সময় ভর্তুকির পরিমাণ ধাপে ধাপে কমিয়ে আনার সুযোগ খুঁজবে। আইএমএফের সঙ্গে করা ঋণ চুক্তি স্মারকে সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি পণ্য, প্রাকৃতিক গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়টি উল্লেখ করে বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য হলো যে এতে করে বিপিসিকে বাজেট সহায়তা দিতে হবে না। সম্প্রতি সরকার যে হারে জ্বালানির দাম সমন্বয় করেছে তাতে এটি বৈশ্বিক দামের প্রায় সমপর্যায়ে চলে এসেছে। ফলে আগামী অর্থবছরের বাজেটে সরকারকে ভর্তুকি কমাতে তেমন একটা বেগ পেতে হবে না। পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ভর্তুকিও কমিয়ে আনতে হবে। এটা কমিয়ে আনা হলেই দেশের জন্য ভালো।
বাংলাদেশের অর্থনীতির এ হেন পরিস্থিতির পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মেগাপ্রজেক্টে ‘মেগা’ খরচ এবং সীমাহীন দুর্নীতি। সেইসাথে প্রশ্ন রয়েছে, বেশ কিছু মেগাপ্রজেক্টের আদৌ কার্যকারিতা আছে কি না। আরও আছে ঋণখেলাপের রমরমা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সম্পদের অপচয় এবং অর্থপাচার। আইএমএফের ঋণ সত্যিই কাজে লাগাতে চাইলে সরকারকে এসব দিকে নজর দিতে হবে। তবে এর বাইরেও অর্থনৈতিক নীতিতে বেশ বড় ধরনের সংস্কার আনতে হবে। নয়তো কেবল সাধারণ সরলরৈখিক পদক্ষেপ নিয়ে কোনো কাজ হবে না। ফেব্রুয়ারি মাসে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল, জ্বালানির দাম বাড়লেও ভর্তুকি আদতে কমছে না। অথচ এই ভর্তুকি কমানোর জন্য দফায় দফায় জ্বালানির দাম বাড়িয়ে নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন লাগানো হলো। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) সরকারকে বাড়তি ৪০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি গুণতে হতে পারে। বাংলাদেশের ভর্তুকি ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের গলদ রয়েছে।
বাংলাদেশের ট্যাক্স টু জিডিপি অনুপাত বেশ দুর্বল। বিশ্বব্যাংকের মতে আদর্শ অনুপাত যেখানে ১৫ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশের জিডিপিতে ট্যাক্সের অবদান মাত্র ৭.৫ শতাংশ। আইএমএফের প্রেসক্রিপশন হলো, করের আয় বাড়াতে হবে। ফলে বাড়াতে হবে করের পরিমাণ এবং আওতা। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ, যারা মূলত মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত, তাদের আয় ‘ট্র্যাক’ করা সহজ নয়। সেইসাথে বাড়তি কর মানে তাদের ওপর বাড়তি বোঝা। তাই বাড়তি কর আদায় করতে হবে ধনীদের থেকে। আইএমএফের শর্তের কারণে সরকারকে এখন বেশকিছু সংস্কার করতে হবে। রাজস্ব খাতে, সুদহারের ক্ষেত্রে, বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও মজবুত করার ক্ষেত্রে সরকারকে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে ঋণের খেলাপ ও আর্থিক কেলেঙ্কারি না ঘটে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আর্থিক নীতির সংস্কার অপরিহার্য।
ব্যাংক ও আর্থিক খাতে নতুন আইন প্রণয়ন ও বিদ্যমান আইন সংশোধনের কিছু কাজ এমনিতেই করা হচ্ছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব সংগ্রহের হার যে কম, তা অস্বীকার করার কিছু নেই। আইএমএফ তাগিদ দিচ্ছে রাজস্ব-জিডিপি হার বাড়াতে। সরকার নিজেও তা চায় এবং এজন্য কাজও চলছে। রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধির জন্য সরকার ইতোমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। অর্থমন্ত্রী চলতি অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় সংসদে যেসব সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছেন, এগুলো প্যাকেজ আকারে আইএমএফের কাছে তুলে ধরা হবে। আইএমএফও সহযোগিতা করবে বলে জানিয়েছে। ব্যাংক খাত সংস্কারের মধ্যে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের মধ্যে রাখা, রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি সংশোধন করা, বছরে চারবার মুুদ্রানীতি করা ইত্যাদি কাজ করতে আপাতত সম্মত হয়েছে সরকার। আইএমএফ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়া যাবে চার বছরে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে যে প্রথম কিস্তি পাওয়া যাবে, তার আগে ওই কিস্তির দ্বিগুণের বেশি পরিমাণ রিজার্ভ কমে যাবে। আইএমএফ’র ঋণ শর্ত অনেকগুলো। ব্যাংকিং খাত সংস্কার, রাজস্ব খাতে সংস্কার ও রাজস্ব বাড়ানো, জ্বালানির উরপ থেকে ভতুর্কি প্রত্যার ইত্যাদি। কিন্তু অন্য খাতে সরকার নজর না দিয়ে নজর পড়েছে জ্বালানি খাতের ওপর। যার কারণেই গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে বা হয়েছে। লেখক: সাংবাদিক