বাজার ঠিক রাখার দায়িত্ব কারÑসরকার নাকি বিরোধীদলের?
মাসুদ কামাল
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর, মানে চতুর্থ মেয়াদে আসার পর প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকে যে কথাগুলো বলেছেন তাহলো, তারা এবার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে। এটা ছিলো একটা পপুলার ইস্যু। মানুষ আসলে সরকারের কাছে কী চায়? সরকারের কাছে মানুষ প্রথমত এটাই চায়, আপনি যেভাবেই সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন। দেশের আইনশৃঙ্খলা বিভাগ, শুল্ক বিভাগ, অর্থবিভাগÑসবকিছু আপনার নিয়ন্ত্রণে। অতএব আপনি এমন একটা ব্যবস্থা করবেন, যাতে সাধারণ মানুষের জীবন কষ্টকর না হয়। সাধারণ মানুষ যেন তার আয় দিয়ে সংসার চালাতে পারে। সেক্ষেত্রে দ্র্রব্যমূল্য হলো খুবই জনপ্রিয় বিষয়। কেউ যদি বলে আমি দ্রব্যমূল্য বা বাজারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে মানুষ খুশি হয়। আশায় বুক বাঁধে। যদিও অনেকে বলেন, এই সরকারের কাছে আশা করারও কিছু নেই। তারপরও আপনি পছন্দ করেন আর না করেন, তারপরও তারাই তো ক্ষমতায় আছে। সরকারের কাছ থেকে কিন্তু জনগণ কিছু একটা আশা করে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই প্রথম মন্ত্রিভায় বলেছিলেন, তাদের প্রধান কাজ হবে দ্রব্যমূল্যকে নিয়ন্ত্রণ করা। বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করা, বাজার যেন যৌক্তিকভাবে চলে সেই জিনিসটা নিয়ন্ত্রণ করা এবং এটা নিয়ে তিনি বলার পর তার মন্ত্রীরাও হাক-ডাক করেছেন। কিন্তু তখন বারবার বলা হয়েছিলো, সামনে রোজা আছে, রোজাকে সামনে রেখে তারা এই কাজগুলো করছেন। কতোটুকু কাজ হয়েছে তাদের এই হাকডাকে? এবং না হলে কেন হয়নি, সে আলোচনাগুলো আমি করতে চাই।
রোজা ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু বাস্তবে রোজার আগের আমরা কোনো পদক্ষেপ দেখছি না। কোনো ফলাফল দেখছি না, কোনো প্রতিফলন দেখছি না। দেখা গেছে তারা যা কিছু বলেছে, মানে বলেছে, কিন্তু জিনিসপত্রের দাম কোনোটারই কমেনি একমাত্র সয়াবিন তেলের দাম সামান্য একটু কমেছে। এটা ছাড়া আর কোনো জিনিসের দামই কমেনি। চাল, পামওয়েল বা অন্য তেলÑ কোনো কিছুর দাম কমেনি। বরং ছোলা, মসুর ডাল, চিনি, খেজুর খেসারির ডাল, পেঁয়াজ এগুলোর দাম বেড়ে গেছে। অর্থাৎ রোজার সময়ে যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে সেগুলোর দামই বেড়ে গেছে। সরকার এগুলোর দাম কমাতে পারেনি। তাহলে কি সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই? যে সরকার এতো বড় বড় কথা বলে তাদের নাকি সবকিছুর উপর নিয়ন্ত্রণ আছে। তাহলে কি সরকারে ব্যবসায়ীদের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই? অনেকে উল্টো করে বলেন, সরকারের কী নিয়ন্ত্রণ থাকবে, ব্যবসায়ীরাই সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে। যারা এ কথাগুলো বলেন আসলেই কি তাদের কথাগুলো সত্য? এ কথার জবাব কে দেবে? রোজায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন থাকে খেসারি ডালের। তার দামও কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে গেছে। খেজুরের দাম বেড়ে গেছে।
নানা অজুহাতে একেকজন একেক কথা বলেন। বলেন, আমদানি করতে পারি না, বাইরে দাম বেশি, সারা দুনিয়ায় দাম বেড়ে গেছে। এসবই অজুহাত। মিথ্যা কথা। যদি একটু ঘাটাঘাটি করেন দেশি-বিদেশি পত্র-পত্রিকা, আপনারা সব বুঝতে পারবেন। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই একটা মিটিং করেছে, সেখানে তারা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ্য করেন, জিনিসপত্রের দাম কেন বেড়ে যায়। তারা চারটি কারণ বলেছেন। এই চারটা কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। [১] ডলার সংকট এবং ডলারের বাড়তি দাম। মানে হচ্ছে, ডলার আসলেই পাওয়া যাচ্ছে না। ডলারের সংকট আছে, কিন্তু তারপরও সরকার যে দামে ডলারটাকে নির্ধারণ করে দিয়েছে, সে দামেও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। এখানে ব্যাংকগুলোর একটা কারসাজি আছে। তারা ডলার ছাড়ছে না। ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বাড়তি দাম নিচ্ছে। এলসি করতে পারছে না এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মালিক তো ব্যবসায়ীরা, বড় বড় ব্যবসায়ীরা এলসি করতে পারছে, কিন্তু ছোট ব্যবসায়ীরা পারছে না। ১০-১২ জন বড় ব্যবসায়ী পুরো বাজারটাকেই নিয়ন্ত্রণ করছেন। সিন্ডিকেটের কথা তো বললামই। ডলারের দামের সঙ্গে এর একটি সর্ম্পক আছে। [২] উচ্চ শুল্ক, সরকার যে শুল্কটা দিয়েছে ব্যবসায়ীরা সেটাকে উপহার মনে করছেন, এটাকে খুব একটা গুরুত্বপূূর্ণ বলে আমি মনে করি না। শুল্ক তো সব সময়ই ছিলো। এটাতো নতুন কিছু না। শুল্কের কারণে দাম বাড়বে, এটা মিথ্যা কথা। শুল্ক আগের মতোই আছে।
[৩] দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাঁদাবাজি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পরিবহনে চাঁদাবাজির বিষয়টা আমরা সবাই জানি। একদম প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি চলে। ধরুন চট্টগ্রাম থেকে একটা জিনিস আসবে। সেটা আসতে আসতে রাস্তায় যে চাঁদাবাজিটা হয় সেটার প্রভাব। কিন্তু জিনিসের দামের উপর পড়ে। এ টাকাটা তো ব্যবসায়ীদের পকেট থেকে দেবে না। সব খরচ পণ্যের উপরই যোগ হয়ে যাবে। পুলিশ সপ্তাহ শুরু হয়েছে, পুলিশ সপ্তাহে কিন্তু আমাদের প্রেসিডেন্ট সেখানে গিয়েছিলেন। তিনিও সেখানে চাঁদাবাজির কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, রাস্তায় চেকিংয়ের নামে অযথা হয়রানি হন। এটা পুুলিশের উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি বলেছেন। রাস্তায় রুটিন চেকিংয়ের নামে অযথা কেউ যেন হয়রানি শিকার না হয় সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে এবং খাদ্যদ্রব্যসহ চাঁদা দেওয়ার কারণে ভোক্তা পর্যায়ে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, জনগণের কষ্ট বাড়ছে। মানে স্বয়ং রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত জানছেন, বলছেন, উদ্বেগ প্রকাশ করছেন যে চাঁদাবাজি হয় এবং চাঁদাবাজির জন্য পুলিশকেও প্রকারান্তরে দায়ী করেছেন। এটাই বাস্তবতা। চাঁদাবাজি করছে কারা। চাঁদাবাজি চাঁদাবাজরা যেমন করছে, তেমনি পুলিশরাও করছে। তাহলে এগুলো কার হাতে?
সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজ, ডলারের দামন, ব্যাংকের বেয়াড়াপনা নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব কার? বিএনপির নাকি? এগুলো বিএনপির লোকজন করে? দেখবেন সরকারের মন্ত্রীরা বলে বেড়ান, বিএনপির প্রশ্রয়ে এগুলো হচ্ছে। তাহলে বিএনপি কি শুল্ক হার বাড়ায়? চাঁদাবাজি কি বিএনপি করে? অথবা এই সিন্ডিকেটরা কি বিএনপির? সবই সরকারের। আপনি দায়িত্ব নিয়েছেন। দায়িত্ব নিলে দায়িত্ব পালন করতে হবে। না পারলে দায়িত্ব ছেড়ে দেন। বলেন, আমি আর পারছি না। বড় বড় ডায়লগ দিয়ে কোনো লাভ নেই। জিনিসপত্রের দাম কমান, জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখুন। বাজারের যে অপারগতা সেটা নিয়ন্ত্রণ আপনাকেই করতে হবে। এই দেশের মানুষ বড় বড় কথা অনেক শুনেছে আর শোনতে চায় না। পরিচিতি : সিনিয়র সাংবাদিক। ‘কথা’ ফেসবুক থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন মাসুদ হাসান