সেবা প্রক্রিয়া সহজীকরণ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ সহজ হবে
রুমানা শারমিন, মো. আমরান হোসেন ও আফিফা চৌধুরী : নানা প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে দ্রুত, কার্যকর, স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল সরকারি পরিষেবার জন্য জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে মিল রেখে এসপিএস প্রক্রিয়া পরিষেবা গ্রহীতাদের সন্তুষ্টিকে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছে। পরিষেবা প্রক্রিয়া সহজীকরণ (এসপিএস) বেসামরিক কর্মকর্তাদের জন্য একটি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে যাতে তারা জনসাধারণের পরিষেবাগুলোতে অ্যাক্সেসকে ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করে, তাদের ব্যবহার করার জন্য নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সময়, খরচ ও ভিজিটের সংখ্যা (টিসিভি) হ্রাস করে। এর ফলে সেবার মান উন্নত হয় ও শেষ পর্যন্ত নাগরিকদের সন্তুষ্টি নিশ্চিত হয়। এসপিএস হলো অ্যাস্পায়ার টু ইনোভেট প্রোগ্রামের একটি অনন্য উদ্ভাবন। ২০১২ সালে এর যাত্রা শুরু হয়েছিলো। এখন পর্যন্ত এই উদ্ভাবনটি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রায় ৮০০টি পরিষেবাকে সহজ করেছে।
এসপিএস এর প্রয়োজনীয়তা বোঝা : এসপিএস-এর প্রয়োজন ধীরে ধীরে নাগরিকদের বিভিন্ন চাহিদা মেটাতে, পরিষেবা সহজ করতে, পদ্ধতির গতি বাড়াতে, আরও সাশ্রয়ী ও দক্ষতার সঙ্গে পরিষেবা প্রদানের জন্য। একত্রে এগুলো পরিষেবা প্রক্রিয়ার একটি বড় উন্নতি ঘটায়। কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা এসপিএস গঠন করে। এটি পরিষেবা প্রাপকদের সর্বাধিক সম্ভাব্য সুবিধার আশ্বাস দেয়, অপ্রয়োজনীয় পরিষেবা প্রক্রিয়াগুলো বাতিল করে, সরলীকরণ প্রক্রিয়ার শুরুতে আগ্রহী কর্মকর্তাদের জড়িত করে, সরলীকরণ পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তাদের ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে সংযোগ ও সহযোগিতা স্থাপন করে। এসপিএস অ্যাপয়েন্টমেন্টের সংখ্যা কমিয়ে আনার একটি উপায় তৈরি করে ও পরিষেবাগুলো পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থহীন কাগজপত্র তৈরি করে। এই পরিষেবাটিতে আইন, বিধি, নীতি ও পদ্ধতিগুলোকে সাবধানে বিশ্লেষণ করার, একটি সম্পূর্ণ কার্যকরী পরিকল্পনার সঙ্গে নতুন ধারণা তৈরি করার একটি মাত্রা রয়েছে। এসপিএস সফ্টওয়্যার সংস্থানগুলোর উপর সৃজনশীল ধারণাগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ও পরিষেবা প্রদানের প্রক্রিয়ায় একটি অতিরিক্ত উপকরণ হিসেবে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করার একটি নতুন উপায় তৈরি করে। সরকারি পরিষেবা যা জটিল প্রকৃতির সময়সাপেক্ষ সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নীতি বাস্তবায়নের পদ্ধতি, অগ্রগতি ও জাতীয় অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করে।
এসপিএস এর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে কোথায় অবস্থান করছে? : বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সাফল্যে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। বিশেষ করে জাতিটি কীভাবে গঠিত হয়েছিলো তা বিবেচনা করে এটি ৫০ বছরেরও কিছু বেশি আগে একটি গণহত্যা ও যুদ্ধ থেকে উদ্ভূত হয়েছিলো। ২০২৬ সালের মধ্যে একটি এলডিসি থেকে একটি উন্নয়নশীল দেশে দেশের স্থানান্তর একটি সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠার পথে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। অগ্রগতি চালিয়ে যেতে এসপিএসকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। অধিকন্তু, বিভিন্ন ডোমেইন জুড়ে অগ্রগতি বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ, ব্যবসার মালিক, শিক্ষাবিদ, আমলা, বিনিয়োগকারী ও অন্যান্য উন্নয়ন স্থপতিদের এই বৃদ্ধির উদ্দেশ্যগুলো স্বীকার করা অপরিহার্য। জাতিসংঘ কর্তৃক পরিচালিত গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে। সর্বোচ্চ ইজিডিআই ব্যাংকিং সহ দেশগুলো (এলডিসি’এস) ও এটি পরপর দুটি সমীক্ষার জন্য এই অবস্থান বজায় রেখেছে। বাংলাদেশ সরকারি সেবা প্রদান নিশ্চিত করার জন্য কার্যকারিতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ই-সরকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইউএনডিইএসএ দ্বারা পরিচালিত ইউএনই- গভর্নমেন্ট সার্ভে ২০২২ অনুযায়ী, যা গত দুই বছরে করা অগ্রগতি মূল্যায়ন করে,১৯৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ আট ধাপ উপরে উঠে ১১১ নম্বরে উঠে এসেছে।
এছাড়াও বাংলাদেশ তার অর্থনীতির অগ্রগতির জন্য উল্লেখযোগ্য ও চলমান ব্যবসায়িক সংস্কার বাস্তবায়ন করেছে। যার মধ্যে রয়েছে সরলীকরণ পদ্ধতি, পরিষেবা প্রদানের মতো স্বয়ংক্রিয় কাজ ও ব্যবসা নিবন্ধন। এটি ট্যাক্স ও মূল্য সংযোজন কর নিবন্ধন শেষ করার পাশাপাশি ট্রেডিং লাইসেন্স পেতে প্রয়োজনীয় সময়কে সংক্ষিপ্ত করেছে। এই উন্নয়নটি বর্ধিত ব্যবসায়িক দক্ষতার জন্য পথ প্রশস্ত করেছে। ফলে বৃহত্তর অর্থনৈতিক সুবিধার দিকে পরিচালিত করেছে। বাংলাদেশে এসপিএস আগে থেকেই জনসাধারণের কাছে চালু করা হয়েছে। পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে যে বেশিরভাগ পরিষেবা গ্রহীতা এসপিএস নিয়ে সন্তুষ্ট ও এর প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। এসপিএস নাগরিক-কেন্দ্রিক মূল্যায়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারি পরিষেবা প্রদান বাড়ানোর জন্য সংশোধনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব করেছে, যা পরিষেবা সরবরাহের ত্রুটি ও অদক্ষতাগুলো উন্মোচন করতে সহায়তা করেছে। জনগণকে আর অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্র, অফিস পরিদর্শন, জটিল আবেদন প্রক্রিয়া, একাধিক অফিসের উপর নির্ভরতা, অপ্রয়োজনীয় পরিষেবা পদক্ষেপ ইত্যাদির উপর নির্ভর করতে হবে না।
এসপিএস এইভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এর জন্য দায়ী: [১] পাবলিক পণ্য ও পরিষেবা জুড়ে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, [২] কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, [৩] অপারেশন খরচ হ্রাস ও [৪] নথি সংখ্যা হ্রাস। এসপিএস-এর জন্য আরও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে সফ্টওয়্যারের ঘাটতি, ইন্টারনেটে সর্বজনীন অ্যাক্সেসের অভাব, পর্যাপ্ত জনবলের অভাব, দক্ষ কারিগরি লোকের অভাব, সরকারি কর্মকর্তাদের ঘন ঘন বদলি, অটোমেশনের অভাব, অপ্রয়োজনীয় নথির প্রয়োজন, প্রয়োজনীয়তার অভাব। বাজেট, যথাযথ যন্ত্রপাতির অভাব ও সর্বোপরি সেবা প্রদানে পক্ষপাতিত্ব ও দুর্নীতি। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে স্থানান্তরিত হওয়ার জন্য এই রূপান্তরটি মসৃণ ও নির্বিঘ্নে নিশ্চিত করার জন্য এই সমস্যাগুলোর সমাধান করা বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য। কারণ এটি স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য প্রদত্ত অনেক সুবিধা হারায়।
ভবিষ্যৎ গঠন করা : প্রতিটি পদ্ধতি ও পরিষেবার তার ত্রুটি রয়েছে। এসপিএস-এর উন্নতির জন্য কিছু পরামর্শের মধ্যে একটি বর্ধিত জনসংযোগ প্রচারাভিযান ও অ্যাক্সেসিবিলিটি-কেন্দ্রিক ইউটিউব ভিডিওগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে যাতে এসপিএস পরিষেবা সম্পর্কে লোকেদের জানা যায়, বিভিন্ন সরকারি পরিষেবা সেক্টরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা, এসপিএস পরিষেবাগুলোর জন্য এ২আই’এস ডিজিটাল কেন্দ্রগুলো ব্যবহার করা, প্রতিটি সরকারি সেক্টরে নিযুক্ত আইসিটি পেশাদারদের সংখ্যা বৃদ্ধি, সফ্টওয়্যার আপডেট করা, স্থানান্তর করা। তাই, সকলের আবেগ ও প্রচেষ্টায় আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের সাফল্য নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হতে পারি।
লেখক : রুমানা শারমিনÑ গবেষক। অ্যাস্পায়ার টু ইনোভেট (এটুআই), মো. আমরান হোসেন একজন তরুণ পেশাদার (এ২আই)। আফিফা চৌধুরী একজন ইন্টার্ন, (এ২আই)। সূত্র : ঢাকা ট্রিবিউন