চট্টগ্রাম বন্দরের বিপুল সম্ভাবনা, শঙ্কা ও চ্যালেঞ্জ
খায়রুল আলম সুজন : গত ডিসেম্বরে সিঙ্গাপুরে আমার সাম্প্রতিক ব্যবসায়িক ভ্রমণের সময় আমি সিঙ্গাপুর বন্দরের টার্মিনাল অফিসে পিএসএ ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেডের কার্গো সলিউশনের প্রধান আলফ্রেড সিমের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। আমি কিছুটা কৌতূহলী ছিলাম যে কেন তারা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে একটি টার্মিনালের উন্নয়ন ও পরিচালনায় বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলো যখন সিঙ্গাপুর বন্দর ৪৪টি দেশে ৬৬টি টার্মিনাল পরিচালনা করে বিশ্বের শীর্ষে রয়েছে। আলফ্রেড সিম তার প্রতিক্রিয়া শুরু করেছিলেন যে বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে অবস্থিত। বিশেষ করে চট্টগ্রামের অবস্থান খুবই আশাব্যঞ্জক। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে আশেপাশের অঞ্চল উপকৃত হতে পারে। তারা বিনিয়োগ করতে চায় কারণ সেখানে সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিমধ্যে, আমরা সিঙ্গাপুর বন্দর অন্বেষণ করতে আগ্রহী ছিলাম। বন্দরের অপারেশন দেখে আমি ভাবছিলাম কীভাবে তারা সিঙ্গাপুরে প্রতিদিন ১০০,০০০ টিইইউএস কনটেইনার এতো অত্যাধুনিক সিস্টেমের সঙ্গে পরিচালনা করে। আলফ্রেড সিম আমাদের জানান যে, সিঙ্গাপুরের সেই কন্টেইনারগুলোর ৮৫ শতাংশই ট্রান্সশিপমেন্ট কন্টেইনার।
তবে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরের বেশির ভাগ কন্টেইনার এই সিঙ্গাপুর বন্দর দিয়েই নেওয়া হয় বলে জানা গেছে। সিঙ্গাপুর বন্দর বিশ্বের বৃহত্তম কন্টেইনার জাহাজ মিটমাট করতে পারে যা চট্টগ্রাম বন্দর পারে না। তাই সারা বিশ্বের কন্টেইনারগুলো চট্টগ্রাম থেকে সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কার কলম্বো ও মালয়েশিয়ার দুটি বন্দর দিয়ে নিয়ে আসা হয়। এরমধ্যে, এখনও বেশিরভাগ কন্টেইনার সিঙ্গাপুর দিয়ে পরিবহন করা হয়। তবে বাংলাদেশে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। মাতারবাড়ি, বে টার্মিনালের মতো প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বন্দরগুলোর পরিবহন নির্ভরতা কিছুটা হলেও কমবে। কন্টেইনার পরিবহনের নতুন রুট চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি ইউরোপ ও আমেরিকায় চালু হবে। তবে এটি পিএসএ-এর ক্রিয়াকলাপগুলোকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে না, কারণ একটি নতুন টার্মিনাল তাদের দ্বারা নির্মিত ও পরিচালিত হওয়ার কথা। চট্টগ্রাম বন্দর ও পিএসএ-এর মধ্যে চট্টগ্রামের বে-টার্মিনালে একটি টার্মিনাল নির্মাণ, পরিচালনার জন্য একটি ছাড় চুক্তি ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে স্বাক্ষরিত হবে।
বন্দর খাতে বিদেশি বিনিয়োগ বাংলাদেশের জন্য একেবারেই নতুন। সরকার অবশ্য ইতিমধ্যেই চট্টগ্রামের পতেঙ্গা টার্মিনাল পরিচালনার জন্য সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালের সঙ্গে একটি ছাড় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। প্রথমবারের মতো, একটি বিদেশি অপারেটরের সঙ্গে একটি চুক্তি বন্দর ব্যবস্থাপনার বাড়িওয়ালা মডেলের দরজা খুলে দিয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে, বন্দর ব্যবস্থাপনার জন্য পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) এর এই মডেলটি সারা বিশ্বে শুরু হয়। বিশ্ব বন্দর ব্যবস্থাপনার জনপ্রিয় মডেলের যুগ বাংলাদেশে বিলম্বে শুরু হয়েছে। পতেঙ্গার পর বে-টার্মিনালের দুটি কন্টেইনার টার্মিনাল এই মডেলে পরিচালিত হবে। এই কারণে, সরকার একটি টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য পিএসএ ইন্টারন্যাশনাল, একটি ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে একটি চুক্তির সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। লয়েডের তালিকা অনুসারে, পিএসএ ২০২২ সালে বিশ্বের এক নম্বর পোর্ট অপারেটর ছিলো যেখানে ডিপি ওয়ার্ল্ড পাঁচ নম্বরে ছিলো। পিএসএ ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইট অনুসারে, ২০২২ সালে তারা সিঙ্গাপুর সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৯০ মিলিয়ন টিইইউএস কন্টেইনার পরিচালনা করেছে।
তারা সিঙ্গাপুর সহ এই দেশগুলোতে তাদের ব্যবস্থাপনায় টার্মিনালগুলোতে প্রতিদিন ২৫০,০০০ টিইউএস কন্টেইনার পরিচালনা করেছে। তারা বিশ্বের ৪৪টি দেশে ৬৬টি টার্মিনাল পরিচালনা করছে। তাদের অফিস রয়েছে ১৭৬টি জায়গায়। বাংলাদেশে এখনো কোনো টার্মিনাল না চালালেও তারা অফিস খুলেছে। পিএসএ-এর মতো নামকরা অপারেটর যদি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে তাহলে তা অনেক সুবিধা তৈরি করতে পারে। তারা এখানে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের আওতায় বিনিয়োগ করবে। আশা করা যায় যে এটি দেশে আরও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে। বন্দরের ভাবমূর্তি সমুন্নত রেখে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতাও বাড়ানো হবে। একাধিক বিদেশি অপারেটর বন্দরের টার্মিনাল পরিচালনা করলে এ খাতে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হবে। এতে আমাদের রপ্তানি খাতও উপকৃত হবে। আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য রেডিমেড পোশাক। বিদেশি ক্রেতারাও অর্ডার দেওয়ার সময় বাংলাদেশের বন্দরকে বিবেচনা করে। তারা বন্দরে যানজট আছে কিনা, পণ্য খালাস করতে কতোক্ষণ সময় লাগতে পারে, বন্দরে কাঁচামাল আমদানি ও রপ্তানি করতে কতো সময় লাগবে ইত্যাদি বিবেচনা করে অর্ডার দেয়। কখন বিদেশি অপারেটররা এর ব্যবস্থাপনায় যোগ দেবে এতে বাংলাদেশি বন্দরগুলো আরো বেশি আস্থা রাখতে পারবে। এটি বন্দর দিয়ে দ্রুত কাঁচামাল আমদানি-রপ্তানির আশা দিতে পারে।
দেখা যাচ্ছে ২৬ বছর আগে ভারত বন্দর খাতে বিদেশি বিনিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছিলো। এখন দেশে বড় অপারেটর রয়েছে। তাদের অনেক প্রতিষ্ঠান এখন দক্ষতার সঙ্গে টার্মিনাল পরিচালনা করছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের একমাত্র কন্টেইনার বন্দর ছিলো চট্টগ্রাম বন্দর। মংলা বন্দর দিয়ে খুব কম পরিমাণে কন্টেইনার পরিবহন করা হয়। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদে অনেক বন্দর প্রকল্প আলোর মুখ দেখেছে। এরই মধ্যে পতেঙ্গা টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে ও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর টার্মিনাল নির্মাণের কাজ চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দরের একটি টার্মিনালও প্রায় শেষের দিকে। আবার বে-টার্মিনালে তিনটি পৃথক টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। সরকার এই নতুন প্রকল্পগুলো তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বা বিশ্বখ্যাত অপারেটরদের সঙ্গে তাদের পরিচালনা করার জন্য কেবল যন্ত্রপাতি খাতে বিনিয়োগ করবে। আমরা আশা করতে পারি যে এই উন্নয়ন বাংলাদেশের বৈশ্বিক সুনাম ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াবে।
লেখক : বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : ডেইলি সান