অর্থনৈতিক কূটনীতি ও অর্থনৈতিক কূটনীতির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা
অনিক দে : বাংলাদেশি কূটনীতিকদের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছেন। যা অর্থনৈতিক কূটনীতিকে অগ্রণী স্থান দেয় এমন একটি কৌশলগত পরিবর্তন চিহ্নিত করে। অর্থনৈতিক সুযোগগুলো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ভিত্তি হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্র নীতির মধ্যে দ্রুত সারিবদ্ধ হয়েছে। ধারণাগতভাবে, কূটনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি একে অপরের সঙ্গে জড়িত। আধুনিক কূটনীতির এই যুগে বৈদেশিক নীতির লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টায় অর্থনৈতিক বিবেচনাকে অগ্রভাগে থাকতে হবে। সুতরাং প্রশ্ন থেকে যায়, ‘অর্থনৈতিক কূটনীতি কী?’
অর্থনৈতিক কূটনীতি: অর্থনৈতিক কূটনীতি একটি দেশের বৈদেশিক নীতি লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য অন্যান্য দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে দেশগুলো বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অন্যান্য অর্থনৈতিকভাবে উপকারী বিনিময় সহ কার্যকলাপের সমস্ত ক্ষেত্রে তাদের জাতীয় লাভ সর্বাধিক করার জন্য বাইরের বিশ্বকে মোকাবেলা করে, যেখানে তারা তুলনামূলক বেশি সুবিধা ভোগ করে। একটি ক্রমবর্ধমান উপলব্ধি রয়েছে যে অর্থনৈতিক সম্পর্কগুলো দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ককে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে ও অর্থনৈতিক কূটনীতি পর্যাপ্তভাবে অনুসরণ না করা পর্যন্ত ভালোভাবে কাজ করবে না। অর্থনৈতিক কূটনীতি লো একটি বহুমুখী শৃঙ্খলা যা ঐতিহ্যগত কূটনীতির সূক্ষ্মতা ও জ্ঞানের দাবি করে। এটির জন্য আর্থিক বিশ্লেষণ, বাণিজ্যিক সম্পর্ক, বিশ্ব বাণিজ্যের নিয়ম, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের রাজনীতির গভীর বোঝার প্রয়োজন। স্বাস্থ্য ও পরিবেশ থেকে বীমা তত্ত্বাবধান পর্যন্ত নীতি বিষয়গুলোও অবিচ্ছেদ্য। কর্পোরেট কাঠামো ও আয়োজক দেশে বড় কর্পোরেশনগুলোর অপারেশনগুলোর বিস্তৃত বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই জটিলতা বৈদেশিক নীতির লক্ষ্য অর্জনে অর্থনৈতিক কূটনীতির গুরুত্বকে বোঝায়।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কূটনীতি: ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ অর্থনৈতিক কূটনীতিতে মনোনিবেশ করা শুরু করে। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক কূটনীতি স্বাতন্ত্র্য লাভ করেছে, যার ফলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জাতীয় স্বার্থ সর্বাধিক করা হয়েছে। সৌদি আরব, জাপান, চীন ও ভারত সহ অনেক দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগে যুক্ত হয়ে সরকার অর্থনৈতিক কূটনীতিতে আগের চেয়ে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো ছাড়া অন্যান্য বাজারগুলোও অন্বেষণ করা দরকার। যেহেতু বাংলাদেশ ২০২৬ সালে একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে স্নাতক হবে, সেহেতু সেসব দেশে মনোযোগ দেওয়া দরকার যেখানে বাংলাদেশ তার বাণিজ্য-ব্যবসা বাড়াতে পারে ও একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে লাভবান হতে পারে। এই সিদ্ধান্তের লক্ষ্য বাণিজ্য ও রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে দেশের স্নাতক বজায় রাখা। এর আগে বাংলাদেশ আরও বেশি দেশের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন ও বাংলাদেশে ব্যবসায় আনার নতুন পথ খুঁজে পেতে অর্থনৈতিক কূটনীতির ওপর জোর দিয়েছিলো। ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ অর্জনের জন্য বাংলাদেশ সরকার কয়েকটি রোডম্যাপ তৈরি করেছে। একটি অর্থনৈতিক কূটনীতি প্যাকেজ ও অন্যটি পাবলিক ডিপ্লোম্যাসি প্যাকেজ। অর্থনৈতিক কূটনীতি প্যাকেজের পাঁচটি উপাদান রয়েছে। এইগুলো হলো : [১] আরও বিদেশি বিনিয়োগ। [২] আরও বাণিজ্য এবং রপ্তানি বৈচিত্র্য। [৩] দেশে ও বিদেশে মানব সম্পদের লাভজনক কর্মসংস্থান। [৪] প্রযুক্তি হস্তান্তর। [৫] বাংলাদেশি প্রবাসী ও অন্যান্যদের জন্য মানসম্পন্ন পরিষেবা।
অর্থনৈতিক কূটনীতির তাৎপর্য : বাংলাদেশকে তার আর্থিক স্বার্থ হাসিলের জন্য অর্থনৈতিক কূটনীতির উপর জোর দিতে হবে। এটি ২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে একটি উন্নয়নশীল দেশে স্নাতক হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটিকে মসৃণ ও টেকসই স্নাতকের জন্য সঠিক কৌশল গ্রহণ করতে হবে। দেশের অর্থনীতিকে অনিশ্চয়তা মোকাবেলায় আরও সক্ষম করতে অর্থনৈতিক কূটনীতির ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাস, কনস্যুলেট ও অন্যান্য সমস্ত কূটনৈতিক প্রতিনিধিত্বকে অবশ্যই নতুন পণ্যের নতুন বাজার অনুসন্ধানে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। অতএব, বর্তমান সময়ে অর্থনৈতিক কূটনীতি শুধুমাত্র বিদেশে বাংলাদেশের মিশনে কর্মরত পেশাদার কূটনীতিকদের দ্বারা নয় মন্ত্রী, আমলা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ প্রভৃতি দেশেও চর্চা করে। বাণিজ্য মেলা ও ফ্যাশন শো আয়োজনের মাধ্যমে বিদেশে বিভিন্ন বাংলাদেশি পণ্যের ব্র্যান্ডিং সহায়ক হতে পারে। এসব ঘটনা ঘটলেও এসব ঘটনার সংখ্যা বাড়াতে হবে। অর্থনৈতিক কূটনীতিতে, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে, আজ, আগামীকাল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্থ প্রদান করবে এমন কারণগুলো খুঁজে বের করা অপরিহার্য। স্পষ্ট অর্থনৈতিক কূটনীতির মাধ্যমে এই মুক্ত-বাজার অর্থনীতিতে টিকে থাকা সহজ। তাই বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক কূটনীতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে ও সেই অনুযায়ী তার পররাষ্ট্র নীতির সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
অর্থনৈতিক কূটনীতি সফল হওয়ার জন্য বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অবশ্যই স্থির বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ প্রবাহ বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের উচিত সড়ক, মহাসড়ক, এয়ারলাইন্স নির্মাণ, ভ্রমণ ও পর্যটনের উন্নয়নে সচেতনভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে আঞ্চলিক সংস্থার সঙ্গে শারীরিক ও সাংস্কৃতিক উভয় ধরনের যোগাযোগের সংযোগ উন্নত করা। অর্থনৈতিক কূটনীতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি অংশ ও পার্সেল। বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৩৫তম। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের পঞ্চম দ্রুত বর্ধনশীল দেশ। এক সময়ের তলাবিহীন ঝুড়ি ২০৩৬ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৫তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে। অর্থনৈতিক কূটনীতির কারণে এই অসাধারণ অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। রাশিয়ান-ইউক্রেন যুদ্ধের আবির্ভাবের পর থেকে আন্তর্জাতিকভাবে যে চলমান রাজনৈতিক ফায়স্কো চলছে, নতুন চ্যালেঞ্জের সঙ্গে স্তূপ করা হয়েছে কারণ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন বড় আকার ধারণ করেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বমুখী ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে তা নিশ্চিত করার জন্য সূক্ষ্ম অর্থনৈতিক কূটনীতি প্রয়োজন।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে বিবিএ ও এমবিএ সম্পন্ন করেছেন। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : ডেইলি অবজার্ভার