বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান রবীন্দ্রবিদ্বেষের কালে সাদী মুহাম্মদের চলে যাওয়া একটি বড়ো ক্ষতি হয়ে উঠছে
কুলদা রায়
মধুর আমার মায়ের হাসি- গানটি বাংলাদেশের দুজন শিল্পী মধুর করে গাইতে পারেন। একজন তপন মাহমুদ আরেকজন সাদী মুহাম্মদ। দুজনেই রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন রেজওয়ানা চৌধুরী আর সাদী মুহাম্মদ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। বন্যা গাইছেন টপ্পাঙ্গের রবীন্দ্রসঙ্গীত। দূরে কোথায় দূরে দূরে/ আমার মন বেড়ায় ঘুরে ঘুরে।
বন্যার গায়নভঙ্গী কণিকা বন্দ্যোপায়ের কাছ থেকে নেওয়া। কণিকা কিন্নরকণ্ঠী। তিনি যেন গানের ওপার থেকে গাইতেন। আহা, হৃদয় মথিত হয় সে সুরে। কী এক আকুতি আমাদের প্রাণে এসে লাগে।
বন্যার টপ্পা টিভি নাটকে সার্থকভাবে ব্যবহার করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর মিউজিক সেন্স ছিল উঁচু মানের। এইসব দিন রাত্রি ধারাবাহিকটিতে প্রথম ব্যবহার করেন দূরে কোথায় দূরে দূরে। এই টপ্পাটি যখন টিভিতে বেজে উঠত, তখন, শুধু আমি নই, আমার বাবাও নিস্তব্ধ হয়ে যেত। আমার মা ডালে ফোঁড়ন দিতে ভুলে যেত। তখন রাত্রিকাল। একফালি চাঁদ বেলগাছে ঝুলে পড়েছে। উঠোনে আমরা পাটি পেতে বসে আছি– শুয়ে আছি। পাটির একপাশে ভুলু কুকুরটির লেজ নাড়া থেমে যেত। এখন বুঝতে পারি, যে কোনো মহৎ শিল্পের কাছে এলে মৌনী হয়ে যেতে হয়। যেমন পাহাড়ে গেলে–সমুদ্রের কাছে গেলে বাক সরে না।
সে সময়ে যুবক গলায় গাইতেন সাগর সেন। আহা কী মিষ্টি আর তেজি গলা- ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা, প্রভু তোমার পানে, তোমার গানে। তবে সাগর সেনের পাশাপাশি সুবীর সেন গাইতেন যেন জ্যোৎস্নার মতো জলরঙের মতো বৃষ্টি হওয়ার পরের ক্ষণের মতো স্নিগ্ধ গলায়। তিনি গাইতেন আজ জ্যোস্নারাতে সবাই গেছে বনে।
সাদী মুহাম্মদকে মনে হয় সুবীর সেনের ভাই। তিনি যেন সুবীরের গলায়ই সুর মিলিয়েছেন। আমার প্রিয় শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সেই গান যখন ক্যাসেট প্লেয়ারে চালাতাম, সেই আশির দশকে, ময়মনসিংহে, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, তুমি কি কেবলি ছবি.. সাদী মুহাম্মদের গলা রাতের হাওয়ার ভেতরে ছড়িয়ে পড়লে, অনেক দরোজা খুলে যেত। সবাই ঘুমোতে ভুলে যেত। তাঁর গানে পদ্মের সুবাস ছিল। তার থেকে বেঁচে থাকার শ্বাসটি খুঁজে নেওয়া যেত।
কাল সেই শ্বাস শেষবারের মতো ফেললেন তিনি। তিনি সাদী মুহাম্মদ। গন্ধর্বজন। নিজেই নিজেকে ছবি করে চলে গেলেন নিজের মতো করে।
সাদী মুহাম্মদের এই স্বেচ্ছা মৃত্যু অনেকের মতো আমারও ব্যক্তিগত শোকের অংশ হয়ে উঠেছে। তার চেয়েও বলা যায়, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান রবীন্দ্রবিদ্বেষের কালে সাদী মুহাম্মদের চলে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য একটি বড়ো ক্ষতি হয়ে উঠছে। লেখক : কবি ওগল্পকার