দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত সঠিক, নাকি ভুল!
কাজী এম. মুর্শেদ
অনেকদিন অর্থনীতি নিয়ে কথা বলছিলাম না। আজ কিছু বলি। বিষয় ব্যাংকের একীভূতকরণ। বাংলাদেশে ৬০-এর উপর বাণিজ্যিক ব্যাংক, সংখ্যাটা অনেক বেশি। এজন্য এমঅ্যান্ডএ বা মার্জার অ্যান্ড এক্যুইজিশন নিয়ে কথা বলেছিলাম। সংজ্ঞা একটু পরিষ্কার করি। মার্জার অর্থ একীভূতকরণ আর এক্যুইজিশন অর্থ অধিগ্রহণ। বাংলাদেশে যেটা বলা হচ্ছে তা একীভূতকরণ, যেখানে একটা ব্যাংক অন্য একটা দুর্বল ব্যাংককের সঙ্গে একীভূত হয়ে একটা ব্যাংক হবে। শরীয়াহভিত্তিক এক্সিম ব্যাংক আর অপেক্ষাকৃত দুর্বল পদ্মা ব্যাংকের একীভূতকরণের খবর আসলো। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ দিই। সেইখানে মূলত মার্জার অনেক কম হয়, এক্যুইজিশন বেশি হয়। একটা প্রতিষ্ঠানের এসেট বা সম্পদ যখন লায়াবিলিটি বা দায় থেকে অনেক বেশি হয়ে পরে, তখন সেই প্রতিষ্ঠান সাহায্য চায়। এই সাহায্য চাওয়াকে বলে চ্যাপ্টার ইলেভেন ফাইল করা। চ্যাপ্টার ইলেভেন ফাইল করার অর্থ একটা মুক্ত অফার দেওয়া, কেউ আমাকে কিনে নেন।
কেউ যদি কেনার না থাকে তখন চ্যাপ্টার এইট ফাইল করে। এর অর্থ উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা নেই। ফলাফল নিজেদের ব্যাংকরাপ্ট বা দেউলিয়া ঘোষণা করা, সরকার উদ্যোগ নেয় সকল এসেট বিক্রয় করে পাওনাদার দেনা শোধ করার। পদ্মা ব্যাংক একসময় ফার্মার্স ব্যাংক ছিলো। এই ব্যাংকের বিভিন্ন ঘটনা আগে থেকে যারা দেখে আসছেন, এটা দেউলিয়া হওয়া সময়ের ব্যাপার ছিলো। সরকারি নিয়মনীতির বাইরে গিয়ে একে জীবিত রাখা হয়েছিলো মালিকানার কিছু বদল করে। বোর্ড সদস্য বদলে চেষ্টা করা হয়েছিলো। সর্বশেষ চেষ্টা ছিলো ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক এক ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার মারফত ক্যাশ-ফ্লো আবার ঠিক করা। সে চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে।
এখানে ব্যাখ্যা দিই। আমেরিকায় ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার কোনো ব্যাংক নয়। তারা মূলত একদল ইনভেস্টমেন্ট উদ্যোগী যারা বিভিন্ন প্রাইভেট ইনভেস্টরদের থেকে অর্থ ধার নেয়। সেখান থেকে তার ইনভেস্ট করে। যেমন ধরুন, অনেকের টাকা আছে। তারা শেয়ারবাজারে ইনভেস্ট করতে চান না টাকা হারাবার ভয়ে। অন্যদিকে ব্যাংকে টাকা রাখলে ০.৫ শতাংশ সুদ পাবে। তারা এমন কোনো ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার খোঁজেন যারা ২.৫ শতাংশ হারে সুদ দেবে, আর সেই ব্যাংক অন্য কোনো কোম্পানি বা বিদেশে ইনভেস্ট করে ৫ শতাংশ সুদ পাবে। ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকাররা অনেকটা ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টদের মতো। তবে অর্থের লেনদেন অনেক বড়। তবে এই ব্যাংকাররা কোথায় ইনভেস্ট করবে সেটা গোপন রাখতে পারে না। আমেরিকার এই আইনগুলো খুবই স্বচ্ছ হতে হয়।
যখন দেখা গেলো বাংলাদেশের এক মৃতপ্রায় ব্যাংককে অক্সিজেন দেওয়ার জন্য তখন এই ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকাররা চুক্তি সইয়ের পরও আর এগোতে পারেননি। পদ্মা ব্যাংক বাঁচানোর জন্য যারা এগিয়ে এসেছিলেন, তারা তেমনভাবে দাঁড় করাতে পারেননি। সরকারি কৃপায় ও সাহায্যে কোনোভাবে টিকে ছিলো। এক্সিম ব্যাংক যে মার্জারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটা ভুল না ঠিক তা সময় বলবে। তবে বাংলাদেশ সরকারের নীতিমালায় একটি ব্যাংক অন্য দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণ এবং ডিসেম্বরের মধ্যে করলে কারো চাকরি যাবে না, এই সিদ্ধান্ত দুইটি আমার কাছে কিঞ্চিৎ অবাক করার মতো মনে হয়েছে। কারণ বলছি। [১] এখানে একীভূতকরণ কেন করতে হবে, অধিগ্রহণের সমস্যা কী আমার জানা নেই। [২] এখানে দুইটা ব্যাংক কেন হবে, কেন চার/পাঁচটা ব্যাংক এক হতে পারবে না? [৩] কারও চাকরি যাবে না কথাটা পুরো ঠিক না। যাবে, তার কোনো ব্যাকআপ ছাড়া।
প্রথম দুই পয়েন্ট পরিষ্কার করেছি। তৃতীয় পয়েন্ট নিয়ে বলি। একটা ব্যাকের কয়েকটা অংশ থাকে। [১] উদ্যোক্তা অধিগ্রহণের মাধ্যমে এক ব্যাচ উদ্যোক্তা পুরো অর্থ ফেরত পেতেন ও মালিকানা হারাতেন। তাদের বোর্ডে থাকার সুযোগ নেই। একীভূতকরণ হলে দুইপক্ষের কিছু থাকবে। ব্যবসা পরিচালনায় নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে আগের চেয়ে কঠিন হবে। [২] শেয়ারবাজারে দুই ব্যাংকের শেয়ারের দাম একই নয়, কোথায় এসে দাঁড়াবে সেটা একীভূতকরণ হলে বাজার ঠিক হবে। কোন অংশের শেয়ার হোল্ডার লাভ করবেন, কোন অংশের লোকসান হবে। [৩] ব্যাংক পরিচালনায় তিনটা লেয়ার আছে। ম্যানেজিং ডিরেক্টর থেকে ইভিপি পর্যন্ত যারা পরিচালনা করে। ভিপি থেকে সিনিয়র অফিসার পর্যন্ত যারা মিড লেভেলে আছে এবং অফিসার থেকে নীচের লেয়ার বা জুনিয়র এক্সিকিউটিভ পর্যন্ত। প্রথম লেয়ারে অর্ধেক লোকের চাকরি থাকবে না। মিড লেয়ারে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার থাকে বলে এদের চাকরি পুরো হুমকির মুখে থাকে না। তবে একই এলাকায় দুই ব্যাংকের ব্রাঞ্চ থাকলে একটা বন্ধ হবে এবং তারা চাকরি হারাবে।
লো লেয়ারে অপেক্ষাকৃত কম লোক চাকরি হারায়, এদের বেতন বেশি না হওয়ায় কোনোভাবে ব্যবস্থা করা যায়। আমার চিন্তা অন্য জায়গায়। ব্যাংক কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা সাধারণ মানুষের তুলনায় প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি বেতন পেলেও তাদের স্কিল সেট খুবই লিমিটেড। তাদের চাকরির দৌড় হয় অন্য কোনো ব্যাংক বা ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউট বা উবার চালানো বা মুদির দোকান দেওয়া। তাদের অন্য কোনো স্কিল সেট নেই। এই বড় সংখ্যায় কর্মী ছাঁটাইয়ের পরবর্তী পদক্ষেপ সরকার কীভাবে সামলাবে বা ব্যাংকগুলো নোটিশ দেওয়ার পর লেবার কোর্টে কীভাবে মোকাবেলা করবে, এই প্রশ্ন থাকবেই। সরকার সেটা অর্থ মন্ত্রণালয় হোক বা বাংলাদেশ ব্যাংক হোক, আরেকবার চিন্তা করা উচিত। মার্জারো থাকবে নাকি এক্যুইজিশনেও যাবে এবং কেন মাত্র দুইটা ব্যাংক একীভূতকরণ হবে, কেন বেশি না? এমনকি কয়েকটা দুর্বল ব্যাংকও একটা কনসোর্টিয়াম ব্যাংক তৈরি করার অনুমতি দেওয়া উচিত। লেখক: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক