রোজার বাজারে আগুন : সরকার কি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পেরে উঠছে না?
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
‘রোজার আগেই ইফতার বাজারে আগুন’Ñ ঠিক এমন একটি শিরোনাম করেছিলো দৈনিক সমকাল। আরো অনেক পত্রিকা, অনলাইন ও টেলিভিশনগুলোর স্ক্রিনেও এমন খবর দেখা গেছে। মানুষ ব্যক্তিগতভাবে নানা কথাবার্তা বলছে রমজানের বাজার নিয়ে। রোজার বাজার নিয়ে আমাদের যত কথা তার মধ্যে লেবু, শসা, চিনি এবং খেজুঁরের দামের কথা বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে, যা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা যেমন একটি সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে, তেমনি মানুষের ভেতরেও আমরা একধরনের প্যানিক বায়িং আমরা দেখতে পাচ্ছি। অর্থাৎ যে জিনিসগুলো ইফতারে লাগে সেগুলোর প্রতিটির দাম এখন বাড়তি।
সরকারের দিক থেকে এতো বাজার নিয়ন্ত্রণের হাকডাক কোনো কাজেই আসলো না তাহলে? দ্রব্যমূল্য কমাতে পারলো না সরকার। তাহলে কি সরকার পেরে উঠলো না ব্যবসায়ীদের সঙ্গে? এ প্রশ্নটিই করছে মানুষ। বাংলাদেশে একটি ধারণা পাকাপোক্ত হয়েগেছে যে রোজার সময় জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। তাই বলে কসাইয়ের মতো গলাকাটার পর্যায়ে চলে যেতে হবে? সেটি নিয়েই মানুষের যত আক্ষেপ। বাজারের বিক্রেতা পক্ষ আমাদের চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় রেখে বাজারে জিনিস আনেন এবং বিক্রি করেন। চাহিদা ও যোগানের যে অর্থনৈতিক তথ্য তা বাংলাদেশের বাজারে খাটছে না। এখানে বিক্রেতারাই সব। তাদের ইচ্ছাতেই দাম নির্ভর হয়।
গত কয়েকবছর ধরে নিত্যপণ্যের দাম বাংলাদেশে অস্বাভাবিক। পাশাপাশি রোজার সময় আমাদের ব্যবসায়ীরা খাদ্যপণ্যের দাম আরো অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে তোলে। এখানে বাজার কমিটিগুলো কাজ করে না। ভোক্তা অধিদপ্তরের যে নানা ধরনের কার্যক্রম আছে সেগুলোও শেষ পর্যন্ত কোনো সুফল বয়ে আনে না। এর অর্থ হলো আমাদের সরকার যে বাজার অর্থনীতির কথা বলে, সবকিছু বাজারের উপরে ছেড়ে দিয়ে দায়হীন হতে চায়, সেই বাজার অর্থনীতি আসলে ফেইল করেছে। বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে যে ফল পাওয়া যাচ্ছে তা আসলে ভোক্তার পক্ষে যাচ্ছে না। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে সরকারের দিক থেকে অঙ্গীকার ছিলো ও আমরা তৎপড়তাও দেখেছি যে দ্রব্যমূল্য কমাতে হবে। কিন্তু তা কোনোভাবেই সম্ভব হয়নি। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ এখন, অতি শোকে পাথরের মতো, কিছু বলতেও পারছে না। নেতাকর্মীদের এতো এতো আশ্বাসের পরেও বাজারে কোনো সুখবর নেই। বাস্তবতা হলো সরকার বা নেতাকর্মীদের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের প্রভাব বাজারে পড়ছে না। ব্যবসায়ীরা এটিকে সেভাবে আমলে নিচ্ছে না।
জানুয়ারি মাস থেকে একটি ভাবনা ছিলো যে রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটবে তো? বাস্তবে কাটলো না। সাধারণ মানুষ আর সরকারের মুখের কথায় আশা রাখতে পাড়ছে না। নিয়মিত বাজার মনিটরিং না হওয়া ও ব্যবসায়ীদের অনৈতিক মুনাফা লুট করার প্রবণতা কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। পৃথিবীর সব দেশে বিভিন্ন উৎসবে জিনিসপত্রের দাম কমে। কিন্তু বাংলাদেশে বাড়ে। পবিত্র রমজান উপলক্ষে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে দেখলাম জিনিসপত্রের দাম কমানো হয়েছে। বড়দিন উপলক্ষে ইউরোপ, আমেরিকার দেশগুলোতে বাজারে পণ্যের মূল্যের বিশাল ছাড় দেওয়া হয়। ভারতেও আমরা পূজার সময় এই বিষয়টি দেখতে পাই। কিন্তু আমাদের দেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন বা উল্টো। রমজান মাস এলে আমাদের দেশের সবরকম ব্যবসায়ী সাধারণ মানুষের পকেট থেকে টাকা নিতে পাগল হয়ে যায়। কারসাজি, সিন্ডিকেট করে যেভাবে পারে তারা মানুষের পকেট থেকে টাকা লুটকরার উৎসবে মেতে উঠে। আামাকে টকশোতে জিজ্ঞেস করা হয় যে, ব্যবসায়ীদের কি কোনো নীতি-নৈতিকতা থাকতে নেই? অবশ্যই থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের কাছে এই প্রত্যাশা করা একদম বোকামি।
যে দেশের ব্যবসায়ীরা খাদ্যপণ্যে বিষ মেশায়, ওজনে কম দেয়, নকল পণ্য বিক্রি করে, সুযোগ পেলে দ্রব্যমূল্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয় তাদের কাছে নীতি-নৈতিকতার আশা করে কী লাভ। এদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সরকারের কার্যকরী ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। শুধু হাকডাক করে, মাঝেমধ্যে বাজারে ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে শেষ পর্যন্ত বাজারে আসলে কোনো প্রভাব ফেলা যায় না। রমজান মাসে দাম বাড়ানোর সংস্কৃতি থেকে আমরা কোনোভাবেই মুক্ত হতে পারছি না। ব্যবসা সংক্রান্ত কোনো বৈঠকে ভোক্তাদের অংশগ্রহণ নেই। ব্যবসায়ীরা সরকারের সঙ্গে কথা বলেন। ফলে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর নীতিনির্ধারণের জায়গায় পৌঁছায় না। পরিচিতি: সিনিয়র সাংবাদিক।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ফেসবুক পেজের ভিডিও কনটেন্ট থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন সঞ্জয় চন্দ্র দাস