মানুষ কীভাবে বুঝবে কোন ব্যাংক খারাপ?
গোলাম মোর্তোজা
বাংলাদেশে ব্যাংকিং সেক্টর, আর্থিক খাত আলোচনায় আসে লুটপাট, ঋণখেলাপি বা ঋণ জালিয়াতি ঘটনা কেন্দ্র করে। ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়া, বেনামে ঋণ নেওয়া ইত্যাদি কারণে আমাদের ব্যাংকগুলোর অবস্থা যে খারাপ তা মোটামুটিভাবে আমাদের সবার জানা। সে জানার জায়গাটিতে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি কাজ করেছে, যার ফলে আমাদের ব্যাংকগুলো আবার আলোচনায় এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বাংলাদেশের অন্য ব্যাংকগুলো নিয়ে ‘রেড জোন’, ‘ইয়েলো জোন’ ও ‘গ্রীন জোন’ নামে তিনটি স্থরে তালিকা করেছে। এখন স্বাভাবিকভাবেই রেড জোনে থাকা ব্যাংকগুলোকে বিপজ্জনক ব্যাংক বলা হচ্ছে। ইয়েলো জোনের ব্যাংকগুলোর অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো। আর গ্রীন জোনের কাতারে যারা আছে তাদের অবস্থা ভালো। বাংলাদেশে ব্যাংক এই তালিকাটি করলো এবং গণমাধ্যমে প্রকাশ করলো।
বাংলাদেশে ব্যাংকের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড নীতি, তথ্য গোপণ করা বা চাপা দেওয়ার নীতি ও বাংলাদেশে ব্যাংকের ক্ষমতা দিয়ে রাষ্ট্রের অন্যান্য ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রণ না করতে পারার ব্যর্থতা ইত্যাদি কারণে তারা অভিযুক্ত। বর্তমানে যে তালিকা বাংলাদেশে ব্যাংক প্রকাশ করলো সেটি নিয়ে তারাই আবার বলছে যে এই তালিকা করা হয়েছে তাদের গবেষণা করার জন্য, এটি সাধারণ পাঠকের জন্যে নয়। বাংলাদেশে ব্যাংকের দায়িত্ব মানুষের টাকা নিশ্চিত করা যাতে করে টাকা খোয়া না যায়, তা না করে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড নীতি পালন করছে।
বাংলাদেশে ব্যাংক নিজে যে তালিকা করেছে সেখানে থাকা রেড জোনের ব্যাংকগুলোর সম্বন্ধে বলার চেষ্টা করছে যে এই তালিকা প্রকাশের জন্য নয়। কেন তালিকা প্রকাশের জন্য নয়? ব্যাংক যদি রেড জোনে থাকে, যদি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয় বা গ্রাহকের টাকা যদি অনিরাপদ হয় তাহলে এটি কেন বাংলাদেশে ব্যাংক প্রকাশ করবে না? রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সিআইডির তদন্তে যাদের নাম আসে তারা এখন পদোন্নতি পেয়ে বাংলাদেশে ব্যাংকের মুখপাত্র হয়েছে। তারাই এখন আবার তথ্য গোপণ করছে। বাংলাদেশে ব্যাংক নিজেদের করা তথ্য নিজেরা গোপণ করছে। অর্থাৎ নিজেরা নিজেদের সঙ্গে প্রতারণা করছে।
যে ব্যাংকগুলো রেড জোনের কাতারে রাখা হয়েছে সেই ব্যাংকগুলোর নাম যদি প্রকাশিত হয় তাহলে মানুষের মনে একটি বিরূপ ধারণা তৈরি হতে পারে, মানুষ সেই ব্যাংকগুলো থেকে টাকা তুলে নিতে পারে যা ব্যাংকগুলোর জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর অবস্থা খারাপ আর সেটি যদি তাকে জানানো না হয় তাহলে গ্রাহক না বুঝে যদি একটি খারাপ ব্যাংকে তার টাকা রাখে এবং সেটি যদি অনিরাপদ হয়ে যায় তাহলে সেই দায় কে নেবে? এটি বিবেচনা করছে না বাংলাদেশ ব্যাংক।
রেড জোনে থাকা রাষ্ট্রআয়ত্ব ব্যাংকগুলো হলো- জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক। অর্থাৎ রাষ্ট্রায়ত্ব চারটি ব্যাংক রেড জোনে আছে। বাকি পাঁচটি বেসরকারি ব্যাংক হলো- বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ন্যাশনাল ব্যাংক এবং এবি ব্যাংক। বাংলাদেশে ব্যাংকের করা তালিকা অনুযায়ী এই নয়টি ব্যাংক রেড জোনে। তার মানে এই ব্যাংকগুলোর অবস্থা ভালো নয়। এখন এসব ব্যাংকে মানুষ টাকা রাখবে কি না সেটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি শুধু বাংলাদেশে ব্যাংকের রেড জোন তালিকাভুক্ত নয়টি ব্যাংকের নাম বললাম।
ইয়েলো জোনে রাষ্ট্রআয়ত্ব ব্যাংক আছে দুইটি- সোনালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। এছাড়া আরো কিছু ব্যাংক আছে এই তালিকায়- আইএফআইসি ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ডাচবাংলা ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, এসবিএসি ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক সহ আরো কিছু শরীয়া ভিত্তিক ব্যাংক।
গ্রীণ জোনে যে ব্যাংকগুলো রয়েছে- প্রাইম ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, হাবিব ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, ব্যাংক আলফালাহ, ব্যাংক এশিয়া, সীমান্ত ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়াসহ কয়েকটি ব্যাংক। এই তিনটি তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক তালিকা থেকে শুরু করে যতগুলো ইন্ডিকেটর আছে সেসব কিছু বিবেচনা করেই তারা প্রকাশ করেছে। তারা নিজেদের গবেষণার জন্য করলেও ভুল তালিকা করেনি। সুতরাং যে ব্যাংকগুলো রেড জোনে আছে সেগুলোর নাম জানানো আমি মনে করি বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব। মানুষ টাকা রাখবে কী রাখবে না সেটি মানুষের সিদ্ধান্ত। পরিচিতি: সিনিয়র সাংবাদিক। গোলাম মোর্তোজা ফেসবুক পেজের ভিডিও কনটেন্ট থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন সঞ্জয় চন্দ্র দাস