বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো তার ভিত্তি ধরে রেখেছে
হাসনাত আব্দুল হাই : ২০২৩ সালের গোড়ার দিকে শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক মন্দার পর থেকে বেশকিছু মানুষ ও বিশেষজ্ঞ ভবিষ্যদ্বাণী করে আসছিলেন যে, বাংলাদেশ শীঘ্রই শ্রীলঙ্কার পথে যাবে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির পতন সময়ের ব্যাপার। তাদের ভয়ানক পূর্বাভাসের মূল ফোকাস ছিলো আমদানি বিলের রেকর্ড পরিশোধের কারণে আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে ঋণ পরিশোধ, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ও নিকট মেয়াদে মেগা প্রকল্পের জন্য সরবরাহকারীদের ঋণের কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। তৎকালীন সামষ্টিক অর্থনীতির উন্নয়নের আলোকে উভয় আশঙ্কাই সঠিক বলে দেখা যেতে পারে। কিন্তু তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি একতরফা ছিলো ও বৈদেশিক মুদ্রার ফ্রন্টে সংকট মোকাবেলার লক্ষ্যে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার যে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে তা বিবেচনায় নেয়নি।
মজুরি উপার্জনকারীদের ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্সের পরিমাণ ও রপ্তানির স্থির বৃদ্ধির পেছনে, বিশেষ করে রেডিমেড গার্মেন্টস (আরএমজি) জন্য, বাংলাদেশে ২০২০-২০২১ (ঋণ২১) অর্থবছরের আগস্ট মাসে রেকর্ড পরিমাণ ইউএসডি ৪৭.৫০ ডলার বিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিলো। কোভিড মহামারী শেষ হওয়ার পরে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পরে হঠাৎ আমদানি বৃদ্ধির কারণে রিজার্ভের চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যায়। যার ফলে এর স্থির অবক্ষয় ঘটে। আমদানিকৃত পণ্যের আন্তর্জাতিক মূল্য বৃদ্ধি, মালবাহী সহ রপ্তানি খাতে ধীর পুনরুদ্ধারের কারণে অর্থপ্রদানের গুরুতর ভারসাম্য পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। ফলস্বরূপ, ২০২১ সালের জুন মাসে রিজার্ভ ৪১.৮২ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। জুন, ২০২২-এ ৩১.২০ বিলিয়ন ডলার ও জুলাই, ২০২৩-এ ২৯.৭৩ বিলিয়ন ডলার। পেমেন্ট ব্যালেন্স ও ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম-৬) এর উপর ভিত্তি করে আইএমএফ গণনা অনুসারে সামঞ্জস্য করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে, বিপিএম-৬ অনুসারে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিলো ২৩.৩৮ বিলিয়ন ডলার। আবার নভেম্বরে, ২০২৩ সালে রিজার্ভ দ্রুত হ্রাস পায় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে উপলব্ধ পরিসংখ্যান অনুসারে বিপিএম-৬ এ পরিমাপ করা ১৯.৩০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকের নগদ স্টক কমে যাওয়ায় ও ভল্টে নগদযোগ্য ক্রেডিট সংকটের মধ্যে প্রবল চাপের মধ্যে থাকায় আর্থিক খাত একটি কঠিন তারল্য পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, বাণিজ্যিক ব্যাংকে বাড়তি তারল্য আগের মাসে ১ দশমিক ৬৪ ট্রিলিয়ন টাকা থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবরে ১ দশমিক ৫৮ ট্রিলিয়ন টাকায় নেমে এসেছে। আগস্টে নগদ উদ্বৃত্ত ছিলো ১.৭৪ ট্রিলিয়ন টাকা। তারল্য সহায়তা প্রদানের জন্য, বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৩ সালের জুলাই মাসে ৭.৭৫ শতাংশ বর্ধিত রেপো হারে ১.৩৩ ট্রিলিয়ন টাকা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তারল্য সহায়তা নীতি অব্যাহত রয়েছে। এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক কারেন্সি সোয়াপ ট্রেডিং চালু করেছে যার অধীনে ব্যাংকগুলো তাদের ফরেক্স কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে স্পট রেটে বিক্রি করতে পারে যা এখন প্রতি ডলার ১১০ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, নগদ প্রায় ১৫টি মুদ্রা অদলবদল নীতির আওতায় অনাহারে থাকা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এ পর্যন্ত ১০৩.৫১ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে। এই নীতির ফলস্বরূপ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একটি শক্তিশালী প্রত্যাবর্তন দেখিয়েছে যা প্রমাণ করে যে মাত্র সাত দিনে রিজার্ভ ১ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। নতুন নীতির ফলে ০৫ মার্চ স্থূল বৈদেশিক রিজার্ভের মোট মূল্য দাঁড়িয়েছে ২৬.১৭ বিলিয়ন ডলার। বিপিএম-৬ এর আইএমএফ মেট্রিক অনুসারে, মঙ্গলবার (০৫ মার্চ) রিজার্ভ বেড়ে ২০.৯৮ বিলিয়ন ডলার হয়েছে যা ফেব্রুয়ারিতে ছিলো ১৯.৯৭ বিলিয়ন ডলার। বিলিয়ন নতুন নীতিটি সম্ভব হয়েছে কারণ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত বৈদেশিক মুদ্রা কিনেছিলো ও এখন স্থানীয় মুদ্রার জন্য তারল্য সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। ২.৭ শতাংশ হারে যে হারে ব্যাংকগুলো টাকার বিনিময়ে ডলার বিনিময় করতে পারে তা রেপো রেটের ৭.৮ শতাংশ থেকে অনেক কম হওয়ায় ব্যাংকগুলো ট্রেড-অফ-এ অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত বোধ করে। তারা তাদের বৈদেশিক মুদ্রা ফেরত পেতে পারে ভবিষ্যতের তারিখে যখন চুক্তিটি নিষ্পত্তি করা হবে একই বিনিময় হারের উপর ভিত্তি করে সোয়াপ পয়েন্টের সঙ্গে প্রয়োগ করে। সুদের হারের পার্থক্য বিদ্যমান বিনিময়ের বেঞ্চমার্ক হার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিগত হার বিবেচনা করে। কারেন্সি অদলবদল ছাড়াও, সরকার কর্তৃক আরোপিত আমদানির উপর পরিমাণগত নিষেধাজ্ঞার ফলে আমদানি বিলের কারণে কম চাহিদার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও লাভবান হয়েছে।
একটি সংবাদ প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি অর্থবছরের (ঋণ২৪) প্রথম চার মাসে আমদানি বাবদ অর্থপ্রদান হয়েছে ২০.২৭ বিলিয়ন ডলার যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ২৫.৫১ বিলিয়ন ডলার ছিলো। আমদানি হ্রাসের পরিমাণ হয়েছে ২০.৫৪ শতাংশ। এটি চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ভারসাম্য ঘাটতিতে প্রতিফলিত হয়েছে। যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ৯.৬২ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ৩.৮১ বিলিয়ন ডলার ছিলো। এটি ঘুরেফিরে চলতি অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সেও প্রতিফলিত হয়েছে। গত অক্টোবরে কারেন্ট অ্যাকাউন্টে ০.২৩ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত ছিলো যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে তা ছিলো ৪.৪৯ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি। তবে, বেসরকারি খাতের বাহ্যিক ঋণ গ্রহণ ও পোর্টফোলিও বিনিয়োগে বিনিয়োগকৃত তহবিলের প্রত্যাবর্তন সম্পর্কিত আর্থিক অ্যাকাউন্টে ঘাটতি বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অন্যান্য চাহিদা হলো ঋণ সেবা ও ঋণদাতাদের কাছে সরকার কর্তৃক ঋণ পরিশোধের কারণে। বাংলাদেশের ঋণ-জিডিপি অনুপাত বর্তমানে ২২ শতাংশ যা খুব বেশি বলা যায় না। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের বর্তমান পরিমাণ স্থিতিশীলতা ও মধ্যমেয়াদী ঋণ সেবার ক্ষমতার আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের প্যারামিটারের মধ্যেই রয়েছে। সম্প্রতি আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক কর্তৃক করা ঋণের স্থায়িত্ব বিশ্লেষণে বাংলাদেশকে আর্থিকভাবে নিরাপদ ও নিরাপদ হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু সরকার সন্তুষ্ট নয় ও নতুন মেগা প্রকল্প গ্রহণে ধীরগতির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য সর্বদা জনসংখ্যার জীবনযাত্রার মান উন্নত করা হয়েছে, বিশেষ করে যারা মধ্যম ও নিম্ন আয়ের গোষ্ঠীভুক্ত। সম্প্রতি প্রকাশিত হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে, ২০২২-এর প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে সামগ্রিক দারিদ্র্য ২০২২ সালে ১৮.৭ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ২০১৬ সালে ছিলো ২৪.৩ শতাংশ। হার্ড কোর দরিদ্রদের ৫.৬ শতাংশে নেমে এসেছে বলে দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রথমবারের মতো জনসংখ্যার ধারণার ভিত্তিতে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা জরিপ করে। ২০২২ প্রকাশ করেছে যে জনসংখ্যার ২১.১১ শতাংশ খাদ্যের প্রাপ্যতা সম্পর্কে অনিরাপদ বোধ করে। বিবিএসের অজান্তেই এই পরিসংখ্যান দেশে বিরাজমান দারিদ্র্য পরিস্থিতি সম্পর্কে বাস্তবতা দেখায়। সংক্ষেপে বলা যায়, একাধিক সমস্যার সম্মুখীন বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও তার ভিত্তি ধরে রেখেছে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে একটি অনাকাক্সিক্ষত অবস্থানে রয়েছে। বাদ দেওয়া বা কমিশনের মাধ্যমে নীতিগত ভুল করার জায়গা খুবই সীমিত। নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই সূক্ষ্ম ও আবহাওয়া-বিক্ষিপ্ত হতে হবে।
যধংহধঃ.যুব৫@মসধরষ.পড়স অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : দি ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস