ধনী-গরিবের মধ্যে সম্পদের ক্রমবর্ধমান ব্যবধান বাড়ছেই
এ কে জিয়াউদ্দিন আহমেদ : আমরা প্রায়শই মিডিয়াতে ধনী ব্যক্তিদের বাড়াবাড়ি সম্পর্কে সরস গল্পের মুখোমুখি হই। প্রায়শই আমরা এই গল্পগুলোকে অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য হিসেবে উপলব্ধি করি। ২০০৭ সালে ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি মুকেশ আম্বানি তার স্ত্রী নীতা আম্বানিকে জন্মদিনের উপহার হিসেবে ৬০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের একটি এআর বাস-৩১৯। ফোর্বস অনুসারে, মুকেশ আম্বানি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে ৯তম স্থানে রয়েছেন। গত বছর ১২১ কোটি রুপি আনুমানিক ব্যয়ে নির্মিত নীতা মুকেশ আম্বানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তার ছেলে অনন্ত আম্বানি ১৮ কোটি রূপি মূল্যের একটি হাতঘড়ি পরেছিলেন। যা বর্তমান বিনিময় হারে আনুমানিক ২.১৮ মিলিয়ন ডলার মূল্যের। অ-ধনী মানুষের কাছে এটি অযৌক্তিক বলে মনে হয় যে একটি ঘড়ি যা সময় প্রদর্শনের জন্য ব্যবহৃত হয় তার এতো দাম হওয়া উচিত নয়। ঠিক আছে আমাদের আশা করা উচিত নয় যে একজন বিলিয়নেয়ার একটি সাধারণ ঘড়িতে সময় দেখবেন। সর্বোপরি, তার সময় আমাদের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান।
যদি আপনার কাছে অনেক সম্পদ থাকে তবে আপনি তা ব্যয় করার বিভিন্ন উপায় খুঁজবেন। সৌভাগ্যবশত আবার এমন অনেক উদ্ভাবনী ব্যবসায়ী আছেন যারা সর্বদা বিলিয়নেয়ারদের প্রয়োজন মেটাতে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ, হিমায়িত হট চকোলেটের সাধারণ মূল্য প্রায় ৫ ডলার। ২০০৭ সালে নিউইয়র্কের আইকনিক রেস্তোরাঁ সেরেনডিপিটি-৩ এটির একটি অনন্য সংস্করণ চালু করে। যা ২৮ ধরনের কোকোর মিশ্রণে তৈরি ও ২৩-ক্যারেটের ৫ গ্রাম স্বর্ণ দিয়ে সজ্জিত। যা অবশ্যই ভোজ্য। এই অসামান্য ট্রিটটির দাম ছিলো ২৫,০০০ডলার। যা অতি-ধনীদের জন্য উপযুক্ত। অনন্ত আম্বানীর হাতঘড়িতে ফিরে গেলে, এটা সবসময় যুক্তি দেওয়া যেতে পারে যে এটা তার টাকা যা সে এটা অর্জন করেছে। সুতরাং সে তা তার ইচ্ছামতো ব্যয় করার অধিকার রাখে। কিন্তু তবুও কিছু ঠিক মনে হচ্ছে না। বিশ্বব্যাংকের দারিদ্র্য ও ইক্যুইটি ব্রিফ অনুসারে গত অর্থবছর ২০২২-২৩ এ ভারতের ১৬০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ প্রায় বাংলাদেশের সমগ্র জনসংখ্যার সমান যারা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করতো।
ইতালীয় পরিসংখ্যানবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী কোরাডো জিনি, ০ থেকে ১ এর স্কেলে আয়ের বৈষম্য পরিমাপ করার জন্য একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। যা জিনি সহগ বা জিনি সূচক নামে পরিচিত। বিশ্বব্যাংক তার দারিদ্র্য ও অসমতা প্ল্যাটফর্মে জিনি সূচক প্রদান করে। ২০২১ সালে ভারতের জিনি সূচক ছিলো ৩৪.২। যা আয় বণ্টনে মাঝারি বৈষম্য নির্দেশ করে। আয়ের পরিবর্তে সম্পদ অর্থনৈতিক অবস্থানের আরও সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। স্ট্যাটিস্টা অনুসারে, ২০২১ সালের শেষে ভারতের সম্পদ জিনি ছিলো ০.৮২, যা ২০০০ সালে ০.৭৫ থেকে বেড়েছে। যা সমাজে সম্পদ আহরণে উচ্চ-স্তরের অসমতার ক্রমবর্ধমান প্রবণতাকে নির্দেশ করে। শুধু ভারতেই নয়, সারা বিশ্বে সমাজের শীর্ষ ও নিম্ন স্তরের মধ্যে সম্পদ আহরণের ব্যবধান বাড়ছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংস্কার ও নিয়ন্ত্রণমুক্তকরণ, বিশেষ করে রাশিয়া ও চীনের মতো কমান্ড অর্থনীতিতে, এই প্রবণতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চীনে বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা ২০০৩ সালে শূন্য থেকে বেড়ে ২০১৮ সালে ৩৭৩ হয়েছে, কেঝো জিয়াওর একটি গবেষণা নিবন্ধ অনুসারে, ক্ষুদ্র ব্যবসা অর্থনীতি জার্নালে এই তথ্য জানান। দ্য গার্ডিয়ানের রিপোর্ট অনুসারে, ২০২৩ সালে বিশ্বের ২,৬৪০ বিলিয়নেয়ারের মধ্যে অন্তত ৫৬২ জন চীনের ছিলো।
১৯৮৭ সালে ফোর্বস প্রথমবারের মতো বিলিয়নেয়ারদের তালিকা প্রকাশ করে ও সেই তালিকায় মাত্র ১৪০ জনের নাম ছিলো। ১৪০ থেকে ২,৬৪০ পর্যন্ত বিলিয়নেয়ারদের বৃদ্ধি প্রথম দর্শনে ইতিবাচক বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আমরা যদি সম্পদ বণ্টনের প্যাটার্নের গভীরে অনুসন্ধান করি, তাহলে তা উদ্বেগ বাড়ায়। ক্রেডিট সুইস, এখন ইউনিয়ন ব্যাংক অফ সুইজারল্যান্ড (ইউবিএস) দ্বারা অধিগ্রহণ করা হয়েছে, ২০১০ সাল থেকে গ্লোবাল ওয়েলথ রিপোর্ট প্রকাশ করছে। ২০২৩ রিপোর্টে একটি গ্লোবাল ওয়েলথ প্রজরামিড রয়েছে যা ২০২২ সালে প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার মধ্যে বিশ্বব্যাপী সম্পদের বণ্টন দেখায়। প্রজরামিড দেখায় যে শুধুমাত্র ২০২২ সালে বিশ্বের ১.১ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ৪৫.৮ শতাংশ বৈশ্বিক সম্পদ ছিলো। অন্য ১২ শতাংশ সম্পদের ৩৯.৪ শতাংশ বৈশ্বিক সম্পদের অধিকারী ছিলো। এইভাবে, প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার মাত্র ১৩.১ শতাংশ বিশ্বব্যাপী সম্পদের ৮৫.২ শতাংশ ও বাকি ৮৬.৯ শতাংশ এর মাত্র ১৪.৮ শতাংশ এর মালিক। তাই সম্পদের বণ্টন কোনোভাবেই ন্যায়সঙ্গত নয়। সম্পদের বেশির ভাগই গুটিকয়েকের হাতে কেন্দ্রীভূত।
আবার যদি আমরা ২০১২ ও ২০২২ সালের সম্পদ পিরামিডগুলোর ভিত্তি স্তর ও শীর্ষ স্তরের সঙ্গে সম্পর্কিত মাথাপিছু সম্পদ গণনা করি তবে নিম্নলিখিত দৃশ্যটি উঠে আসে: এইভাবে, ধনীরা আরও ধনী হয়েছে ও দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হয়েছে। দারিদ্র্যের মধ্যে জন্মগ্রহণকারী লোকদের অর্থনৈতিক মইয়ের উপরে উঠতে কঠিন হবে। সমাজগুলো উত্তেজনা, নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হবে ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা শুরু হতে পারে কারণ জনসংখ্যার অধিকাংশের সম্পদের অ্যাক্সেসের অভাব হবে। আন্তর্জাতিক স্তরে সম্পদের বৈষম্যের গুরুতর প্রভাব রয়েছে। যা একটি দেশের অবকাঠামো, শিক্ষা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বহিরাগত ঋণ, বাণিজ্য ভারসাম্য ও শেষ পর্যন্ত এর সার্বভৌম সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।
লেখক : সাবেক কর্পোরেট প্রফেশনাল ও একাডেমিক। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : ডেইলি সান