মন্দের ভাল নাকি ব্যাংক পরিচালকদের দোষ লুকানো?
ওয়াসি মাহীন
দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর গুরু বলা চলে ন্যাশনাল ব্যাংককে। আধুনিক ব্যংকিং পেশার স্কিলড ম্যানফোর্স গঠনে ব্যাংকটির অবদান কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। এখনো অনেক ব্যাংকের যোগ্য টপ ম্যানেজমেন্টের অনেকের শিক্ষাগুরু এই ন্যাশনাল ব্যাংক। চোখের সামনে ব্যংকটাকে শেষ হতে দিয়েছি আমরা। অথচ এই ব্যাংকের ওপর প্রান্তিক পর্যায়ে বিশ্বাস ও আস্থার কমতি ছিলো না।
ধীরে ধীরে পারিবারিক ব্যাংকে রূপ নিতে নিতে অন্য ব্যংকের এমডিকে গুলি করা, কোটি টাকা বিদেশে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে পাঠাতে সাহায্যসহ চোখ কপালে উঠা অনেক ঘটনা প্রমাণ করছিল এই ব্যাংকের ভবিষ্যৎ। সার্ক ফোয়ারার মোড়ে কয়েক দশক ধরে চলা তাদের হেড অফিস নির্মাণ এখনো অসম্পূর্ণ। এটা আর সম্পূর্ণ হওয়ার সুযোগ দেখছি না।
মুন্সিগঞ্জের নিমতলাতে অনেকটা গ্রামের ভেতরেই সুবিশাল ৬ তলা ভুতুড়ে মার্কেট করে সেটাও এক প্রকার পরিত্যক্ত করা হয়েছে। এত বড় মার্কেট ঢাকা শহরেও খুব বেশি নেই। এই যে টাকার যাচ্ছেতাই ব্যবহার, এগুলোর ব্যাপারে আগে থেকে কেউ তেমন মাথা ঘামায়নি। ঘামালে পরিস্থিতি এমন হতো না বলে আমার বিশ্বাস। অনেকবার বলেছি ব্যাংকিং একটা ডিসিপ্লিনড সেক্টর। এখানে কিছুর প্রশ্রয় দিলে পুরো দেশকে ভুগতে হতে পারে। অথচ প্রায় অধিকাংশ ব্যাংকের অবস্থা এখন নাজুক।
প্রধান সমস্যা ২ টি। এক, প্রফিট যা দেখানো হয় তা মেনিপুলেটেড ফিগার। এটা অঘোষিতভাবে সবাই জানে। যিনি অস্বীকার করবেন তিনিও জানেন।
দুই, ঋণের যে অংশ ক্লাসিফাইড হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, সেটা মোটেও প্রকৃত চিত্র নয়। বরং প্রতি প্রান্তিকে নতুন ক্লাসিফিকেশন ঠেকাতে, পারলে নিজের পকেট থেকে দিয়েও হাফ ছেড়ে বাচার মত উপায়। ঋণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলে ক্লাসিফায়েবল লোনের পরিমাণ অনেক বেশি। এর জন্য দায়ী ভয়ঙ্কর স্বেচ্ছাচারিতা।
অতীতে অনেক লেখায় বলেছি, পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আইনসিদ্ধ বিষয়। আমাদের দেশে লিগাল ফ্রেমওয়ার্কে এটা স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হলেও এদেশে ব্যাংকের ডিরেক্টর অধিকাংশই (মনে হয় সবাই) নিজেকে পরিচয় দেয় বা দেয়া হয় ব্যাংকের মালিক হিসেবে। সেইসঙ্গে জরিপ চালালে হয়ত দেশের শতভাগ মানুষ, ব্যাংকগুলিকে অমুক সাহেবের ব্যাংক পরিচয়েই চেনে।
অথচ পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি তাও আর্থিক খাতের মত স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানে যেখানে ব্যাংকের মূল দায় সাধারণ জনগণের ডিপোজিট, সেখানে সেই অর্ধলক্ষকোটির দায় এড়িয়ে স্বল্প মূলধনের স্পনসর ডিরেক্টরদের পরিচয়ে ব্যাংকের সব সিদ্ধান্ত পুরো ইন্ডাস্ট্রিকে বিপদে ফেলেছে। অনেক পত্রিকার রিপোর্ট মোতাবেক, ব্যাংক লাইসেন্সের জন্য মূলধনের জোগাড় হয়েছেও অপ্রত্যক্ষভাবে ঋণ করে যেটা আইন বহির্ভূত।
এত কিছু হয়েছে, হচ্ছে সবাই জেনেছে। কিন্তু অব্যবস্থাপনাকারী দাম্ভিকদের ভয়ে অনিয়মগুলোই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক প্রাকটিসে পরিণত হয়েছে। গুটি কয়েক ঋণগ্রহীতাদের কাছে ব্যাংক হয়ে পড়েছে বন্দি। আর নিজেদের স্বাস্থ্য ভাল সেটা নূন্যতম কাঠামোতে প্রমাণ করতে টপ ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে শুরু হয়েছে টার্গেট নামক বস্তু। সব টার্গেটের মূল টার্গেট প্রফিট। যেকোনো মূল্যে প্রফিট। টার্গেট পূরণ না হলে চাকরি নিয়ে টানাটানি। পরিবার বাঁচানোর তাগিতে অবাস্তব টার্গেট আর প্রফিটের নেশায়, ঋণ মূল্যায়নে সতর্কতার পরিবর্তে বেড়েছে ভুল ফাইনান্সিং।
ব্যাংক ইন্ডাস্ট্রিগুলির মুনাফাখোরি মনোভাব থাকা উচিত নয়। ডলার ক্রাইসিসের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক ডজন খানেক ব্যাংকের ট্রেজারির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি করেছে অতি মুনাফা করার জন্য।
যেকোনো অতিমুনাফার ফল আপনার জন্য ভাল হলেও অপর প্রান্তে কেউ না কেউ অন্যায্য ক্ষতির মধ্যে পড়বেই। দিনশেষে আপনার অতি লাভ অন্য কারোর জন্য উইন উইন হয় না। উইন উইন পরিস্থিতিতে অতিমুনাফার সুযোগ নেই। ন্যায্যতা এখানে মুখ্য।
আমরা দীর্ঘবছর ধরে রুই কাতলাদের বস্তা বস্তা খাবার জুগিয়েছি। আর তারা এই খাবার বিভিন্নভাবে উগড়ে দিয়েছে দেশের বাইরে। বিলাসি জীবনযাপনে। সাধারণ মানুষের কষ্টের বিনিময়ে অর্থের উচ্ছৃঙ্খল ব্যবহার করেছে। অনেক ব্যাংকের স্বাধীনতা নেই কিছু বরোয়ারের ক্ষেত্রে ঋণ গাইড লাইন ফলো করার। অনেক বিগ শট আছেন যারা পুন:তফশিলের সব সংখ্যা ছাপিয়ে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছেন বিশেষ অনুমতির সুযোগ নিয়ে। গাইডলাইনের তোয়াক্কা না করেই।
দেশটা আমাদের। দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি ব্যাংকিং খাত। এই খাত বিনিয়োগ উপযোগী ফান্ড এক স্থানে জরো করতে পারে। এই খাত জরোকৃত ইনভেস্টমেন্ট উপযোগী ফান্ড সঠিক স্থানে যথাযথ বিনিয়োগ করে দেশের অর্থনীতির চাকা চালু রাখতে পারে।
এরকম গুরুত্বপূর্ণ খাতে যখন দেশে আলোচনা সমালোচনা চলছে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স না দেয়ার জন্য, তখনো নতুন অনেক ব্যাংক জন্ম নিয়েছে। যৌবনে পৌঁছার আগেই এদের অধিকাংশ এখন অস্তিত্বের সংকটে। বাধ্য হয়ে এখন প্রশ্ন আসছে মার্জারের।
মার্জার ছাড়া আসলে বিকল্প তেমন নেই। দুর্বল ব্যংকগুলোর জন্য দায়ী বিগ শট হলেও এর পূর্ণ ঝড় সহ্য করতে হবে কর্মকর্তা কর্মচারীদের। বাংলাদেশ ব্যংকের গাইড লাইন অনুযায়ী অন্তত ৩ বছর তারা সময় পাবেন চাকরি থাকবে কি থাকবে না সেই প্রশ্ন আসবার আগে। আমার ধারণা এতে অনেক মানুষের চাকরি যাবে ৩ বছর পর। একি স্থানে কোন ব্যাংক দুটি ব্রাঞ্চ রাখবে না। রাখলে সেটা আর্থিকভাবে ভায়াবল হয় না। আর এক্ষেত্রে একটা শ্রেণি দ্বিতীয় শ্রেণির ব্যাংকার হবার মত রেসিজম টাইপ কিছু ফেস করলেও করতে পারেন।
তবে মার্জারের বিনিময়ে সবল ব্যংকগুলো বেশকিছু সুবিধা পাবে। তারা সি.এল.আর, এস.এল.আর, ঋণ প্রভিশনিং এর ক্ষেত্রে ছাড় পাবেন। ফরেক্স সাপোর্ট পাবেন। তবে এতে বড় ঝুঁকি যেটা থেকে যায় সেটি হল, সবল ব্যাংকগুলোও দুর্বল হওয়ার শঙ্কায় পড়তে পারে। ঋণ প্রভিশনিং এ ছাড় ব্যাংগুলির আর্থিক সামর্থ্যকে হুমকিতে ফেলতে পারে। হতে পারে এই ধারাটা ছোয়াছে ও খারাপ প্রাকটিস হিসেবে পুরো ইন্ডাস্ট্রিতে ছড়িয়ে পড়েছে।
তবে বাংলাদেশ ব্যংক হ্যাবিচুয়াল ডিফল্টারদের নিয়ে দারুন সার্কুলার দিয়েছে। এরকম কিছু আর ১০ বছর আগে থাকলে ব্যাংক খাত উপকৃত হতে পারত। কিছু ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ক্ষমতা বা প্রশাসনের সঙ্গে মিলে কাজ করার মত উদ্যোগ অনেক ঐচ্ছিক ডিফল্ডারদের থেকে ব্যাংককে বাচাতে পারে। টাকা পরিশোধের ক্ষেত্রে একটা সেচ্ছা অনীহা এখন প্রায় দেখা যায়। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলো তড়িৎ কোনো রেমিডি পায় না। মামলা অনেক সময় সাপেক্ষ। আবার সি.আর মামলা এখন অনেক বরোয়ার থোড়াই কেয়ার করে।
বিবির নির্দেশনায়, ঐচ্ছিক ডিফল্টার চিহ্নিত হলে বিদেশ ভ্রমন বন্ধ করা হবে তাদের। তবে এক্ষেত্রে আরো কঠোর হিসাবে পাসপোর্ট ব্লক করার মত কাজ করা যেতে পারে। এদের আইনগত ফাঁক ফোকর ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করার মত লিগাল কাঠামো করা যেতে পারে। অনেকেই আছেন ব্যাংকের টাকা দেন না। কিন্তু বিএমডভিলউ, মার্সিডিজ চেঞ্জ করেন নিয়মিত।
মার্জারের মত সেন্সিটিভ কাজের সময় অবশ্যই সর্বব্যাপী শক্ত অবস্থানে থাকাটা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে বড় কেউ বিশেষ পারমিশন নিয়ে পার যেন না পায় সেই ব্যবস্থা করা জরুরি। আদালত, প্রশাসন, ব্যাংক, সবাইকেই শক্ত অবস্থানে থাকা জরুরি। ব্যাংকের নীতি নির্ধারণে এবং অপারেশনে বোর্ডের ইচ্ছা, হস্তক্ষেপ যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার মত স্পেস বিবিকে এনশিউর করাটা জরুরি।
দেশের এনবিএফয়াই গুলোর প্রায় সবগুলোর অবস্থা করুণের থেকেও খারাপ। ব্যাংকগুলোর অবস্থা যেন অমন না হয় সেই দায়বদ্ধতা থেকেই সবার দেশের স্বার্থে কাজ করা উচিত।