শেয়ারবাজারে ব্যাপক দরপতন ডিএসইতে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন সূচক
মাসুদ মিয়া: [১] দেশের শেয়ারবাজার দরপতনের বৃত্তে আটকে পড়েছে। কোন ভাবেই চাঙ্গা হচ্ছে না। আর ২২ দিনবাদে পবিত্র ঈদুল ফিতর। ঈদকে সামনে রেখে বিনিয়োগকারীরা ভেবেছিল এবার শেয়ারবাজার চাঙ্গা হবে। কিন্তু চাঙ্গা না হয়ে বড় দরপতন হচ্ছে। ঈদকে সামনে রেখে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হাহাকার বেড়েছে। এদিকে দরপতন ঠেকাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা নানা উদ্যোগ নিলেও তা কাজে আসছে না। ফলে প্রতিদিন পুঁজি হাড়াচ্ছে বিনিয়োগকারীরা। [২] গতকাল সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস সোমবার ব্যাপক দরপতনের মধ্যে দিয়ে লেনদেন শেষ হয়েছে। ডিএসইতে প্রায় তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে সূচক। আর এই নিয়ে টানা ৭ কার্যদিবস ধরে শেয়ারবাজারে সূচক নিম্নমুখী অব্যাহত রয়েছে। ব্যাপক পতনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। গত কয়েকদিনের মতো গতকাল সোমবার সূচকের উর্ধমুখী ধারায় বাজারে লেনদেন শুরু হয়। কিন্তু এ ধারা কয়েক মিনিটের বেশি টেকেনি। [৩] এবিষয়ে বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বর্তমানে শেয়ারবাজারে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আস্থাহীনতার অভাব। সে কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্কে পড়েছে। এই আতঙ্কের কারনে শেয়ার বিক্রির মহোৎসবে মেতেছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে শেয়ারবাজারে দর পতনের সঙ্গে লেনদেনের খরা হচ্ছে। [৪] এবিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ কমেছে কোম্পানিগুলোর ডিভিডেন্টও কমেছে সে কারনে বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকট রয়েছে। এই সংকট কাটাতে উদ্যোগ নিতে হবে।
[৫] তিনি আরও বলেন, শেয়ারবাজারে দরপতনের কোন যৌক্তিক কারন নেই। মির্জ্জা আজিজ বলেন, গুজবের ওপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ না করে, ভালো করে কোম্পানির অতীত-বর্তমান পর্যালোচনা করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। এবিষয়ে বিনিয়োগকারী রাজ্জাক বলেন, ২২ দিন পর ঈদ এখন যদি বাজার ভালো না হয় ঈদ কিভাবে করবো আমরা বিনিয়োগকারীরা। [৬] রাজ্জাক বলেন, ২০১০ সালের ধসের পর সম্প্রতি শেয়ারবাজার অনেকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। এতে বাজারে নতুন করে বিনিয়োগ বাড়িয়েছি। কিন্তু গত একমাস ধরে দরপতনে বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে পড়েছি। বাজারে প্রতিদিন যে হারে পতন হচ্ছে তাতে আবারও পুঁজি হারানোর শঙ্কার মধ্যে পড়ে গেছে। হঠাৎ কেন এমন পতন হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। [৭] জামান নামে আরেক বিনিয়োগকারী বলেন, প্রতিদিনই ভাবি আজ হয়তো শেয়ারের দাম একটু বাড়বে। সকালের দিকে দাম একটু বাড়লেও দিন শেষে দরপতন হচ্ছে। প্রতিদিনই বিনিয়োগ করা পুঁজি হারাচ্ছি। আমি যে কয়টি শেয়ার কিনেছি, সবগুলোতে লোকসানে রয়েছি। এই লোকসান কোথায় গিয়ে থামবে কিছুই বুঝতে পারছি না। [৮] এভাবে বাজার পড়তে থাকলে সবার মধ্যেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে। আমি যাদের সঙ্গে কথা বলছি, সবাই হতাশার সুরে কথা বলছে। [৯] নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসইর এক পরিচালক বলেন, সার্বিকভাবে বাজারে এখন এমন দরপতনের বস্তুনিষ্ঠ কোনো কারণ দেখছি না। চলতি সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস সোমবার তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন সূচক। ফলে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা বেড়েই চলেছে।
[১০] গতকাল মূল্যসূচকের বড় পতনের সঙ্গে কমেছে লেনদেনের গতিও। ডিএসইতে ৫০০ কোটি টাকার কম লেনদেন হয়েছে। অন্য শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের দাম কমেছে। ফলে সবকটি মূল্যসূচকের বড় পতন হয়েছে। এর মাধ্যমে টানা সাত কার্যদিবস শেয়ারবাজারে দরপতন হলো। আর শেষ ২৩ কার্যদিবসের মধ্যে ২০ কার্যদিবসেই দরপতন দেখতে হলো বিনিয়োগকারীদের।
এর আগে গত সপ্তাহে লেনদেন হওয়া পাঁচ কার্যদিবসেই শেয়ারবাজারে দরপতন হয়। এতে একই সপ্তাহেই ডিএসইর বাজার মূলধন ৪৯ হাজার কোটি টাকার ওপরে কমে যায়। [১১] গতকাল শেয়ারবাজার লেনদেন শুরু হয় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম বাড়ার মাধ্যমে। ফলে লেনদেন শুরু হতেই ডিএসইর প্রধান সূচক ২ পয়েন্ট বেড়ে যায়। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের দাম বাড়ার ধারা অব্যাহত থাকায় লেনদেনের এক পর্যায়ে ডিএসইর প্রধান সূচক ২৩ পয়েন্ট বেড়ে যায়। কিন্তু সকাল সাড়ে ১০টার পর থেকে বাজারের চিত্র বদলে যেতে থাকে। ১১টা সাড়ে ১২টার মধ্যে বড় ধরনের ধস নামে শেয়ারবাজারে। সব খাতের সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানের দাম কমায় এক পর্যায়ে ডিএসইর প্রধান সূচক ৭৮ পয়েন্ট কমে যায়। শেষদিকে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের দরপতনের মাত্র কমায় সূচকের পতন কিছুটা কমে। এরপরও সবকটি সূচকের বড় পতন দিয়েই দিনের লেনদেন শেষ হয়।
[১২] দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইতে দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে মাত্র ৩৪টি প্রতিষ্ঠান। বিপরীতে দাম কমেছে ৩৩০টি প্রতিষ্ঠানের। আর ৩২টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। এতে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ৬৯ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৮৯৮ পয়েন্টে নেমে গেছে। এর মাধ্যমে ২০২১ সালের ২৫ মে’র পর সূচকটি সর্বনিম্ন অবস্থানে অবস্থান করছে। ২০২১ সালের ২৫ মে ডিএসইর প্রধান সূচক ৫ হাজার ৮৮৪ পয়েন্ট ছিল। এরপর সূচকটি আর এত নিচে নামেনি।
অন্য দুই সূচকের মধ্যে বাছাই করা ভালো ৩০টি কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক আগের দিনের তুলনায় ৮ পয়েন্ট কমে ২ হাজার ৪২ পয়েন্টে অবস্থান করছে। আর ডিএসই শরিয়াহ্ সূচক আগের দিনের তুলনায় ১৩ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ২৮৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
সবকটি মূল্যসূচক কমার পাশাপাশি লেনদেনের পরিমাণ কমেছে। [১৩] ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৪৮৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ৫১৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। সে হিসেবে লেনদেন কমেছে ২৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।
এ লেনদেনে সব থেকে বেশি অবদান রেখেছে গোল্ডেন সনের শেয়ার। কোম্পানিটির ১৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছ। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ফু-ওয়াং সিরামিকের ১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। ১৫ কোটি ১০ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে গোল্ডেন হার্ভেস্ট এগ্রো।
[১৪] এছাড়া ডিএসইতে লেনদেনের দিক থেকে শীর্ষ দশ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে-লাভেলো আইসক্রিম, সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস, লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ, বেস্ট হোল্ডিং, এস এস স্টিল, আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ এবং আফতাব অটোমোবাইল।
[১৫] অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক সিএএসপিআই কমেছে ১৬১ পয়েন্ট। বাজারটিতে লেনদেন অংশ নেওয়া ২২৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪৬টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ১৫৭টির এবং ২৪টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। লেনদেন হয়েছে ১২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয় ১৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।