আমাদের সব সংস্থা কি নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ?
মো. মাজেম আলী মলিন : দেশে এখন দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া। গ্রামে বা শহরে কোথাও জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। সরকারের নানা কৌশল, ভোক্তা অধিকার কিংবা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে পারছে না। বিপাকে পড়েছেন সাধারণ কর্মজীবীসহ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ। বিশ্বে যুদ্ধ, মহামারি, রোগবালাই থাকলেও অসাধু ব্যবসায়ী ও প্রশাসনের নজরদারির অভাবই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রধান কারণ বলে মনে করেন সকলে। একের পর এক অজুহাত দেখিয়ে মধ্যস্বত্বভোগী ও মজুতদাররা ইচ্ছেমতো জিনিসপত্রের দাম বাড়ালেও এর কোনো প্রতিকার নেই। মাঝেমধ্যে ভোক্তা অধিকার নিয়ে প্রচারণা চালানো হলেও কিছুদিন পর পরিস্থিতি আবার আগের মতো। এভাবে প্রতিটি পণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হচ্ছে। সরকার নির্ধারিত দাম অনুযায়ী বাজারে পণ্য কিনতে পাওয়া যাচ্ছে না।
ক্রেতাদের সবসময় বেশি দামে পণ্য কিনতে হয়। সরকার আমদানিকারক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে দাম নির্ধারণ করে। তাহলে কেন ভোক্তাদের বেশি দামে কিনতে হবে? বাজার অস্থিতিশীল হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষকরা। কারণ কারসাজির মাধ্যমে কোনো পণ্যের দাম কয়েকগুণ বাড়লেও কৃষকরা সেই দাম পান না। সেই টাকা যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। আবার আমদানি করা হলে ওইসব কৃষক উৎপাদন খরচও বহন করতে পারবে না। লোকসানে বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের। অনেক কৃষক কৃষিকাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। আমাদের কৃষিজমি প্রতিনিয়ত কমছে। তাদের মধ্যে অনেকেই কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষিকে টিকিয়ে রাখা ছাড়া কৃষকদের কোনো বিকল্প নেই। যুদ্ধ ও করোনার পর অনেক দেশ মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটে পড়লেও বাংলাদেশ খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এর অবদান নিঃসন্দেহে কৃষি। এ কারণে বাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর একে অপরকে দোষারোপ না করে সমন্বয় করা এখন বেশি জরুরি। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে তথ্য ও বাজার ব্যবস্থাপনা জোরদারের ওপর জোর দিতে হবে। বাজারের অস্থিতিশীলতার জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে এর জন্য প্রয়োজন সমন্বয়।
সমন্বয় করতে না পারলে এই অদৃশ্য শক্তির হাতে দেশের মানুষকে প্রতিনিয়ত ভুগতে হবে। কখনও পেঁয়াজ, কখনও সবুজ মরিচ, কখনও চিনি, মুরগি, তেল বা অন্য কোনও পণ্য শহরগুলোর তুলনায় গ্রামে নিত্যপণ্যের দাম বেশি। দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চাপে সাধারণ মানুষ ভুগছে। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, শহরের তুলনায় গ্রামে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে বেশি। এতে বলা হয়েছে, দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি জানুয়ারিতে সামান্য কমে ৫.৮৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা ডিসেম্বরে ছিলো ৬.০৫ শতাংশ। জানুয়ারিতে নগরীতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিলো ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। কিন্তু গ্রামে এই হার ৬.০৭ শতাংশ। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, বিবিএসের নমুনা এলাকা থেকে তথ্য নিয়ে মূল্যস্ফীতি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। তাই এখানে যে তথ্য আসবে তা রিপোর্টে প্রতিফলিত হয়েছে। তবে গ্রামের তুলনায় শহরে নিত্যপণ্যের দাম কম হওয়াটা অস্বাভাবিক। কারণ সবই গ্রাম থেকে উৎপাদিত হয়ে শহরে আসে। ফলে শহরে দাম কিছুটা বাড়তে পারে তবে গ্রামে কম থাকতে হবে।
গত জানুয়ারিতে গ্রামে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ। তবে নগরীতে এই হার ৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ। অর্থাৎ গ্রাম থেকে একই পণ্য কিনলে শহরের চেয়ে বেশি দাম দিতে হবে। সে অনুযায়ী গ্রামের তুলনায় শহরে নিত্যপণ্যের দাম কম। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের ক্ষেত্রে দেখা গেছে মূল্যস্ফীতি গ্রামাঞ্চলে ৬.০৭ শতাংশ ও শহরাঞ্চলে ৬.১৭ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে শহরের তুলনায় গ্রামে দাম কিছুটা কম। সার্বিক মূল্যস্ফীতির নিরিখে চাল, আটা, চিনি, ব্রয়লার মুরগি, ডিম, পেঁয়াজ, সবজিসহ প্রায় সব খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। বিবিএস জানায়, ডিসেম্বরে ভোক্তারা এক লিটার তেল কিনতে গড়ে ১৫৬ টাকা ২৫ পয়সা খরচ করেছেন, যা জানুয়ারিতে ছিলো ১৬০ টাকা ১০ পয়সা। দেশে সামগ্রিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়ে ৫.৬০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা ডিসেম্বরে ছিলো ৫.৪৬ শতাংশ। এ ছাড়া খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি সামান্য নেমে এসেছে ৬ দশমিক ২৭ শতাংশে, যা আগের মাসে ছিলো ৭ শতাংশ।
মূলত ভোক্তা অধিকারের বিরুদ্ধে কাজ বা অপরাধ হলো নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বা পরিষেবা বিক্রি বা অফার করা, জেনেশুনে ভেজাল পণ্য বিক্রি বা অফার করা, যে কোনও খাদ্য পণ্যের সঙ্গে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক কোনও নিষিদ্ধ পদার্থ মেশানো ও বিক্রি করা, মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ভোক্তাদের বিভ্রান্ত করা। প্রতারণা, প্রতিশ্রুত পণ্য বা পরিষেবাগুলো সঠিকভাবে বিক্রি না করা, সরবরাহ না করা, ওজন বা পরিমাপের যন্ত্রের সঙ্গে কারচুপি করা, পরিমাপের টেপ বা অন্য কিছুর সঙ্গে কারচুপি করা, যে কোনও নকল পণ্য বা ওষুধ তৈরি করা, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি করা, কোনও নিষিদ্ধ কাজ করা যাতে মানুষের জীবন সুরক্ষিত হয়। অবহেলা, দায়িত্বহীনতা, পণ্যের প্যাকেজিং ব্যবহার না করা বা প্যাকেজিং-এ খুচরা মূল্য, মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ ইত্যাদি না লেখার কারণে পরিষেবা গ্রহীতা বিপন্ন হতে পারে। বেআইনি প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিষেবা গ্রহীতার আর্থিক বা স্বাস্থ্য ক্ষতি ইত্যাদির কারণ হতে পারে। পণ্য, বৈধ ও বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করে দোকান বা প্রতিষ্ঠানের সহজে দৃশ্যমান কোনো স্থানে পণ্যের মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করা, আইনগত বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করে সেবার মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করা। সুধী সমাজ মনে করে এগুলোর কোনোটিই সঠিকভাবে হচ্ছে না যার কারণে সাধারণ মানুষ অসাধু ব্যবসায়ীদের শৃঙ্খল থেকে বের হতে পারছে না। সরকারের সদিচ্ছা ও কঠোর নজরদারি থাকলে সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে থাকতে পারতো।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (সমাজবিদ্যা), রোজী মোজাম্মেল মহিলা অনার্স কলেজ।
অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : ডেইলি অবজার্ভার