বাংলাদেশ কীভাবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করছে?
ড. মোহাম্মদ কামরুল হাসান : ২০১৫ সাল থেকে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো টেকসই
উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য কাজ করছে। জাতিসংঘের সকল সদস্য দেশ তাদের অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন অবস্থা নির্বিশেষে ২০৩০ সালের মধ্যে ২৩১টি সূচকের মধ্যে বিতরণ করা ১৬৯টি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। সব এসডিজি সূচক সব দেশের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। উপরন্তু, প্রতিটি দেশের নিজস্ব বাস্তবতা, সমস্যা ও সম্ভাবনা আছে- তাই অগ্রাধিকার ভিন্ন হয়। বিশ্বব্যাপী লক্ষ্য অর্জন নির্ভর করবে স্থানীয় পর্যায়ে অগ্রাধিকার নির্ধারণ ও বাস্তবে রূপান্তর করার ক্ষমতার উপর। এসডিজি বাস্তবায়নে স্থানীয় বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও স্থানীয় সম্পদের ন্যায্য ব্যবহার- এই সমস্ত বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় আকক্সক্ষায় রূপান্তরিত করতে হবে। এইভাবে, এসডিজি স্থানীয়করণের ধারণাটি বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিভিন্ন দেশ তাদের নিজস্ব ইচ্ছা, অগ্রাধিকারের আলোকে বৈশ্বিক সূচক থেকে তাদের নিজস্ব অগ্রাধিকার চিহ্নিত ও বাস্তবায়ন করছে।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয় বরং বাংলাদেশকে একটি অগ্রগামী দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে। উন্নয়নের স্থানীয়করণকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের মাধ্যম হিসেবে নেওয়া হয়েছে যা এখন দেশের উন্নয়ন দর্শনের মূল লক্ষ্য। ২০১৫ সালে বৈশ্বিক এজেন্ডায় স্বাক্ষর করার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশ এসডিজি বাস্তবায়নে একটি সম্পূর্ণ সমাজ পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। দেশের পরিকল্পনা প্রক্রিয়া বিশেষভাবে, ‘পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এসডিজি-এর চাহিদা ও আকাক্সক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ একটি ব্যাপক কৌশল গ্রহণ করেছে। ইতিমধ্যে, কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় উভয় পর্যায়েই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, ফলাফল-ভিত্তিক পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন কাঠামো ও এসডিজি অর্থায়ন কৌশল তৈরি করা।
বিভাগ, জেলা, উপজেলা পর্যায়ে একটি এসডিজি বাস্তবায়ন ও সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। যাতে বহু-বিভাগীয় অভিনেতাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে। যেমন, সরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও, আইএনজিও, সুশীল সমাজ, উন্নয়ন সহযোগী, বেসরকারি খাত, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, স্থানীয় সরকার সংস্থা ও স্থানীয় সম্প্রদায়। যা দেখে উৎসাহিত করা হয়েছে তা হলো, কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক, কাঠামোগত সেটআপ থাকার কারণে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এসডিজির আরও কার্যকর বাস্তবায়নের উপায় খুঁজে বের করার জন্য আরও খনন করা বন্ধ করেনি। একটি উন্নয়নশীল দেশ হওয়ায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অধীনে সমস্ত বৈশ্বিক সূচক বাংলাদেশের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য নয় ও একই সময়ে সমস্ত সূচক বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। দেশের আর্থিক সক্ষমতার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সুতরাং, একই সঙ্গে সমস্ত সূচক বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। বরং, বাংলাদেশকে কর্মের জন্য অগ্রাধিকার ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে হবে ও বৈশ্বিক সূচকের আলোকে নিজস্ব দেশ প্রসঙ্গগত অগ্রাধিকার তালিকা প্রণয়ন করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিটের (জিআইইউ) নেতৃত্বে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে এসডিজি স্থানীয়করণের যাত্রা শুরু হয়। জিআইইউ সাধারণ অর্থনৈতিক বিভাগ, পরিসংখ্যান ব্যুরো ও এ২আই প্রোগ্রামের সহায়তায় তিনটি স্তরে অগ্রাধিকার সূচকগুলোর একটি দেশ-প্রাসঙ্গিক সেট তৈরি করেছে। জাতীয় স্তরের অগ্রাধিকার সূচক ৩৯; উপ-জাতীয় স্তরের অগ্রাধিকার সূচক ৬৪ (একটি প্রতিটি জেলা) ও উপজেলা পর্যায়ের সূচক: ৪৯২ (প্রতিটি উপজেলার জন্য একটি)। মডেলটি জাতীয় এসডিজি বাস্তবায়ন পর্যালোচনা কমিটিতে ও পরে ২০২০ সালে মন্ত্রিসভা দ্বারা অনুমোদিত হয়েছিলো। অগ্রাধিকার সূচকগুলোকে চিহ্নিত করার প্রক্রিয়াটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছিলো যাতে এটি বিস্তৃত হয়। এর মধ্যে রয়েছে : [১] বাংলাদেশের চাহিদা ও বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে লক্ষ্য, সূচকের তালিকার উপর একটি গভীর গবেষণা ও বিশ্লেষণ, [২] কার্যকর পরামর্শের জন্য প্রাসঙ্গিক স্টেকহোল্ডারদের একটি ম্যাপিং ও [৩] সমস্ত প্রাসঙ্গিকদের সঙ্গে পরামর্শের একটি সিরিজ অংশীদারদের।
প্রথম পদক্ষেপটি ছিলো জাতীয় পর্যায়ে অগ্রাধিকার সূচকগুলো বিকাশ করা। একবার ৩৯টি জাতীয় অগ্রাধিকার সূচক চিহ্নিত হয়ে গেলে, এটিকে আরও অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জাতীয় স্তরের বাইরে আরও নীচে স্থানীয় স্তরে যাওয়ার প্রয়োজন ছিলো। জিআইইউ প্রতিটি জেলা ও প্রতিটি উপজেলার (উপজেলা) জন্য একটি অগ্রাধিকার নির্দেশক রাখার প্রস্তাব করেছে। জাতীয় সূচকের তালিকায় বলা হয়েছে যে দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা, মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বেকারত্ব, অবকাঠামো, উৎপাদন ও আইসিটি খাতের উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সুরক্ষার মতো বিষয়ভিত্তিক ক্ষেত্রগুলো ছিলো অগ্রাধিকার ক্ষেত্র। আমরা যদি জাতীয় পর্যায়ের কিছু সূচক বিশ্লেষণ করি তাহলে এটি আমাদের একটি পরিষ্কার ধারণা প্রদান করবে যে দেশের প্রেক্ষাপটগুলো বাংলাদেশের চাহিদা ও অগ্রাধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেহেতু বাংলাদেশ ক্রমাগত চাষযোগ্য জমি হারাচ্ছে, সেহেতু যে সূচকগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে তার মধ্যে একটি মোট জমির সর্বনিম্ন ৫৫ শতাংশ হারে চাষযোগ্য জমি বজায় রাখার উপর জোর দেয়।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশের আরও প্রচেষ্টার প্রয়োজন বলেও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি সূচক চিহ্নিত করা হয়েছে যা উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে মহিলাদের অংশগ্রহণের শতাংশ ৫০ শতাংশ এ উন্নীত করার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। জিডিপি ও সরকারের রাজস্ব অনুপাত এমন একটি ক্ষেত্র যার জন্য আরও কার্যকর পদক্ষেপের প্রয়োজন। জাতীয় পর্যায়ের সূচকটিও এই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোকে কভার করে ‘জিডিপি-তে মোট সরকারি রাজস্বের অনুপাত ২০ শতাংশ-এ উন্নীত করে।’ একইভাবে, এসডিজি স্থানীয়করণের বাংলাদেশ মডেল দেশের প্রাসঙ্গিক সূচক নির্ধারণের মাধ্যমে প্রকৃত অগ্রাধিকার চাহিদাগুলোকে সামনে নিয়ে আসে। বৈশ্বিক প্রমাণগুলো পরামর্শ দেয় যে জাতীয় অগ্রাধিকার সূচকগুলো কার্যকরভাবে মোকাবেলা করতে পারলে বৈশ্বিক লক্ষ্য সময়মতো অর্জন করা যেতে পারে। চিহ্নিত জাতীয়, জেলা ও উপজেলা অগ্রাধিকার সূচকগুলোকে সঠিকভাবে মূলধারার হতে পারলে উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য কার্যকর নীতি ইনপুট হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক মানদণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে চিহ্নিত সূচক সেটের প্রাসঙ্গিকতা, উপযোগিতা যাচাই করার এখনই সময়।
লেখক : গবেষক ও জনপ্রশাসন অনুশীলনকারী। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : ঢাকা ট্রিবিউন॥॥॥