আঞ্চলিক সড়ককে জাতীয় সড়কে উন্নীত করা, সুষম উন্নয়ন ও অঞ্চলভেদে অর্থনৈতিক বৈষম্য
ওয়াসি উদ্দিন মাহিন
বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় সড়কগুলো লক্ষ্য করুন। ৮টা ন্যাশনাল হাইওয়ের ভেতর সবগুলোর গন্তব্য ঢাকা। যে কথাটি বছর পাঁচেক আগে বলেছিলাম, বসবাসের অযোগ্য জাদুর শহর ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হলে প্রধান যে কাজটি জরুরি সেটি হলো আঞ্চলিক সড়কগুলোকে জাতীয় সড়কমানে উন্নিত করে আন্তঃবিভাগ সংযোগ শক্ত করতে হবে। যখন সাউথ সাউথ কোরিডোরের কথা বলা হচ্ছিল খুব বেশি উচ্ছ্বাসিত ছিলাম এর দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব কল্পনা করে। অবশেষে একটা ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে আঞ্চলিক বেশকিছু সড়ককে জাতীয় সড়কে উন্নীত করা হবে। যদিও এ পরিকল্পনা অনুমোদনের জন্য উঠবে। আদৌ অনুমোদন হবে কি হবে না, সেটা জানা নেই। তবে অনুমোদন না হলে সেটা দেশের জন্য ক্ষতিকর হবে। সচেতনভাবে হোক অথবা অবচেতনভাবে, সারাদেশের সব জেলার গন্তব্য ঢাকামুখী করে রাখা হয়েছে। বিকেন্দ্রীকরণ মানে শুধু সরকারি অফিসগুলো ঢাকার বাইরে পাঠালেই হয় না। বরং এর জন্য জরুরি প্রান্তিক অবকাঠামো উন্নত করা, প্রান্তিক ইকোনোমিক ইউনিটগুলোকে কার্যকর করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। প্রস্তাব অনুযায়ী প্রথম দফায় খুলনা -বাগেরহাট-ঝালকাঠী বরিশাল আঞ্চলিক সড়ককে ৬ লেনের এক্সপ্রেসওয়ের আদলে উন্নিত করা হবে। একইসঙ্গে বিদ্যমান বরিশাল-ভোলা- লক্ষ্মীপুর সড়ককে ৬ লেনে উন্নিত করে মোট ১৩১ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে নির্মিত হবে। বড় বাধা মেঘনা সেতু। তবে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে খুলনা বিভাগ, বরিশাল বিভাগ ও চট্টগ্রাম বিভাগকে একসূত্রে গাঁথা সম্ভব হবে। কোনো প্রয়োজন পড়বেনা ঢাকামুখী হওয়ার।
লিড টাইম কমবে। তবে সব থেকে বড় ব্যাপার হলো এ অঞ্চলের ভোমরা, বেনাপোল স্থলবন্দর, মংলা সমুদ্রবন্দর, পায়রা সমুদ্র বন্দর ও চট্টগ্রাম বন্দর গতিময় এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে একসুঁতায় বাধার সুযোগ আসবে। এর সুফল কি হতে পারে? একটা দেশকে এগিয়ে যেতে গেলে তার বিদ্যমান সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান ও সুযোগগুলোর কার্যকর ব্যবহার জরুরি। যেখানে গ্রোথ পটেনশিয়াল আছে সেটাকে কাজে লাগানো জরুরি। বিশ্বের দিকে তাকালে স্পষ্ট বোঝা যায়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি সমুদ্রকে ঘিরে সব থেকে বেশি। এর কারণেই বার্মার সিত্তও, ইয়াঙ্গুন এতো গুরুত্বপূর্ণ। ইয়াঙ্গুন সমুদ্রকে কেন্দ্র করেই বিকশিত হয়েছে এবং বার্মার বৃহৎ শহরে রূপ নিয়েছে। আর রাখাইনের রাজধানী সিত্তও গ্রোথ পটেনশিয়ালের কারণেই ভারত, জাপান ও চীনের বিনিয়োগ টেনেছে। দুর্ভাগ্য তারা এ সম্পদের সঠিক ব্যবহার করতে না পারায় দুষ্টচক্রে আটকে আছে। এ অঞ্চলের শ্রীলঙ্কা রাজধানী কলম্বো নিজেও বন্দরকে ঘিরেই বিকশিত হয়েছে। এ বাইরে বার্মার সিত্তও এর মতো হাম্বানটোটা চীন, ভারতসহ অন্য দেশগুলোর বিনিয়োগ প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে। পাকিস্তান বারবার রাজধানী পরিবর্তন করলেও সাবেক রাজধানী করাচির মতো বড় শহর একটিও নেই।
সে করাচিকে ছাপিয়ে যেতে না পারার কারণ করাচি বন্দর। সমুদ্রকে কাজে লাগানো আর স্ট্রাটেজিক লোকেশনকে ক্যাপিটালাইজ করার জন্য তারাও গওধর বন্দর কেন্দ্রিক নতুন শহর সৃষ্টির প্রয়াসে বিদেশি বিনিয়োগ টেনেছে বা টানছে। ভিয়েতনামের বৃহৎ শহর ও রাজধানী হিসাবে হো চি মিন সিটি বিকশিত হয়েছে সাইগন বন্দরকে ঘিরে। তানজাং প্রিয়ক বন্দর ঘিরে জাকার্তা হয়ে উঠেছে ইন্দোনেশিয়ার সব থেকে বড় শহর ও রাজধানী। ভারতের বৃহৎ শহর মুম্বাই। মহারাষ্ট্রের প্রধান দুই বন্দর এ মুম্বাইকে ঘিরেই। সিঙ্গাপুর, দুবাই থেকে শুরু করে পৃথিবীর সব বৃহৎ শহর ও রাজধানীর অধিকাংশের পেছনে রয়েছে বন্দরের ভূমিকা। সমুদ্রকে ঘিরেই এ শহরগুলো উন্নত হয়েছে। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রভাবক শহরে রূপ নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রাজধানী হিসেবে ঢাকা বৃহৎ শহর যার আধুনিক সময়ে এসে বড় বন্দরকেন্দ্রিক সাপোর্ট নেই। অনেকটা জোর করেই এটাকে বড় করা হচ্ছে যেটা জাতীয় সড়কগুলোর ঢাকামুখিতা প্রমাণ করে। সমুদ্রকে কাজে লাগানোর অপ্রতুল চেষ্টায় অন্য কোনো বৃহৎ শহর গড়ে উঠেনি। ঢাকা কেন্দ্রিক উন্নয়নের ভিড়ে চট্টগ্রাম যতটুকু বিকশিত হয়েছে তা কেবলমাত্র বন্দরের জন্যই। উল্টাচিত্র বাংলাদেশের সব থেকে অবহেলিত ও দারিদ্রপীড়িত জেলাগুলো বঙ্গোপসাগর ঘিরে দক্ষিণের জেলাগুলোতে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে না উঠায় এ অঞ্চল ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোনের হুমকিতে একপ্রকার পরিত্যক্ত ভীতিকর অঞ্চলে রূপ নিয়েছে দীর্ঘবছরে। তবে বর্তমানে সে ধারায় পরিবর্তন এসেছে। অথচ ৫৮০ মাইলের কোস্টাল লাইন জুড়ে যে সুযোগ আমাদের ছিল তাতে এ অঞ্চলের জেলাগুলো সব থেকে ধনী জেলা হওয়ার কথা। আর সে সূত্রে জাতীয় উৎপাদনে সর্ববৃহৎ অংশীদার হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল এ অঞ্চলের। কিন্তু সমস্যা ও এক জায়গায়। দুর্গম ও ভঙ্গুর যোগাযোগ ব্যবস্থা। এ ধারায় পরিবর্তন আসছে কিছুটা।
বিশেষ করে পদ্মার বড় বাঁধা অতিক্রম করে লেবুখালী সেতু হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত সড়ক পথ সম্ভব হয়েছে। পায়রা বন্দর আংশিক চালু হয়েছে। মংলা পুরাতন বন্দর হলেও যোগাযোগের অপ্রতুলতা এর সম্ভাবনাকে বাস্তবে কাজে লাগানো ক্ষেত্রে বাধা হয়েছে। তবে এখন যদি এ রোডে ৬ লেনের এক্সপ্রেসওয়ে হয়, তবে সাউথ সাউথ কোরিডোরের কাজ হয়ে যাবে। ইন্ডাস্ট্রিগুলোর অধিকাংশ এখানে শিফটিং সম্ভব। কার্যকরী উপকূল প্রতিরক্ষায় প্রকল্পও তখন এমনিতেই হবে। আমার ধারণা সমুদ্রকেন্দ্রীক একাধিক বৃহৎ শহর সৃষ্টির সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হতে পারে। একই ধারায়, যদি রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের সঙ্গে ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগকে যুক্ত করা যায়। তবে উত্তরেও আমূল পরিবর্তন আসবে। ঢাকামুখী হওয়া কমে আসবে। এদিকে খুলনা কুষ্টিয়া রাজশাহী সংযোগ করা গেলে এবং ঢাকাকে পাশ কাটিয়ে সিলেট চট্টগ্রাম দ্রুত ও কার্যকরী যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা গেলে আমার ধারণা দেশে সুষম উন্নয়ন সম্ভব এবং সেক্ষেত্রে অঞ্চলভেদে অর্থনৈতিক বৈষম্য অনেক কমে আসবে। এতে অন্য অঞ্চলের মানুষের জীবনমান যেমন বাড়বে তেমনি ঢাকাও বসবাসযোগ্য শহরে রূপান্তরের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করি। ১১-৩-২৪। লেখক : ব্যাংকার