বিশ্ব অর্থনীতির মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র ও বাংলাদেশের অসীম সম্ভাবনা
নীলরতন হালদার : বঙ্গোপসাগরে বহু-স্তরযুক্ত
সংযোগের একটি সেমিনারে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে থাকা উপ-আঞ্চলিক অঞ্চলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সম্ভাবনার বিষয়ে তার ভবিষ্যৎ অন্তর্দৃষ্টি শেয়ার করেছেন। রাষ্ট্রদূত যখন বিশ্ব অর্থনীতির মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র স্থানান্তরিত হতে দেখেন তখন তিনি আরও বেশি বিন্দু হতে পারেননি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার বিষয়ে জাপানের দূরদর্শিতা বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। এখানে ঢাকা মেট্রো রেল, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল ও আড়াইহাজারে ইপিজেডের মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণে, ঢাকা ও নারিতার মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট চালু করার ক্ষেত্রে এর সহযোগিতা বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারিত্ব বিকাশে তার আগ্রহের সাক্ষ্য বহন করে। তবুও কক্সবাজারে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের স্বপ্নের প্রকল্প, বাংলাদেশে প্রথম সত্যিকার অর্থে বাণিজ্যিক সংযোগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিবেগ শুধু এ দেশেই নয়, দেশের সীমানাও ছাড়িয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্বের সেভেন সিস্টারের ঘনিষ্ঠতার সঙ্গে ২০২৭ সালে সম্পন্ন হওয়ার জন্য নির্ধারিত সমুদ্রবন্দরটি সেই ভারতীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে তার সুবিধাগুলো ভাগ করে নিতে পারে।
জাপানি রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এটা স্পষ্ট যে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের উপযোগিতা সর্বাধিক করার জন্য তার দেশ দীর্ঘ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছে। বাংলাদেশে অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি, জাপানও উত্তর-পূর্ব ভারতে অনুরূপ অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণে মনোনিবেশ করেছে। বঙ্গোপসাগরের গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে জাপান সঠিকভাবে নির্দেশ করে যে কীভাবে সেভেন সিস্টারস ও বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে কানেক্টিভিটি বাড়ানো যায়। জাপানি রাষ্ট্রদূত পশ্চিমবঙ্গ, ভুটান ও নেপাল; দুটি স্থলবেষ্টিত দেশকে কভার করার জন্য বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সংযোগের সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করেছেন। রাষ্ট্রদূতের অনুভূতির প্রতিধ্বনি করে বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাও মাতারবাড়িকে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ, সহযোগিতার আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার বাস্তববাদকে সমর্থন করেছেন। গভীর সমুদ্রবন্দরের সৌজন্যে আঞ্চলিক অর্থনীতির পরিবর্তনের লক্ষ্যে অবকাঠামো নির্মাণে জাপান যে অংশীদারিত্বমূলক ভূমিকা পালন করছে তার প্রশংসা করেছেন তিনি।
খাগড়াছড়ির রামগড় ও ত্রিপুরার সাব্রুমের স্থল শুল্ক স্টেশনগুলো সমুদ্রবন্দর চালু হওয়ার পরে সংযুক্ত হয়ে গেলে এই অঞ্চলের রাজ্যগুলো কেবল কাছাকাছি আসবে না। কার্যকর, অর্থবহ অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সহযোগিতার জন্য একটি দিকনির্দেশনা লাভ করবে। বঙ্গোপসাগরে পেট্রোলিয়াম ও হাইড্রোকার্বনগুলোর জন্য প্রত্যাশিত অফশোর অনুসন্ধান সফল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গভীর সমুদ্রবন্দরের বাণিজ্যিক কার্যকারিতা বহুগুণ বেড়ে যেতে পারে। নীল অর্থনীতি যখন শোষণ করা হয় তখন দেশকে অভূতপূর্ব সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে পারে। এখন যেহেতু ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ ও বাংলাদেশের বেশিরভাগ কর্মক্ষম বয়সের যুব জনসংখ্যার গর্ব তাদের পক্ষে তাই তারা একসঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার সমৃদ্ধির যুগে নেতৃত্ব দিতে পারে। ভারতীয় উন্নয়ন দৃষ্টান্তের পিছনের উঠোনে থাকা সাত বোন বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মিথস্ক্রিয়া ও সহযোগিতার মাধ্যমে অত্যন্ত উপকৃত হবে। নেপাল-ভুটান তাদের রপ্তানি-আমদানি বাড়াতে মাতারবাড়ি বন্দরের সংযোগ ও অ্যাক্সেস ব্যবহার করতে পারে। তাদের জন্য এই সুবিধা সবদিক দিয়েই আশীর্বাদ হিসেবে প্রমাণিত হবে। বাংলাদেশ ও নেপালের পাশাপাশি ভুটানের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের সুবিধার্থে ভারতের মাধ্যমে নতুন স্থল ও রেল রুট, স্থল পোস্ট ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে বিবেচনা করার জন্য বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে ভারতকে অনুরোধ করেছে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে অব্যবহৃত প্রাকৃতিক সম্পদ শুধুমাত্র ভারতের জন্য নয়, বাংলাদেশ ও বিশ্বের অন্যান্য স্টেক-হোল্ডারদের জন্যও অর্থনৈতিক স্বার্থ যুক্ত করবে। জাপান বিশ্ব অর্থনীতির মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্রের স্থানান্তরকে ভালোভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে ও অর্থ, উন্নত প্রযুক্তির ব্যাপক বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে এসেছে। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আড়াইহাজার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলটি শুধুমাত্র জাপানি বিনিয়োগকারীদের জন্য উৎসর্গ করা হয়েছে। কিন্তু এই অঞ্চলের পূর্ণ উৎপাদনশীল ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনার ফসল কাটাতে উত্তর-পূর্ব ভারত, নেপাল ও ভুটানে একই ধরনের বিনিয়োগ করতে হবে। যদি জাপানি রাষ্ট্রদূতের বিবৃতি কোনো নির্দেশিকা হয় তাহলে উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলো এই ধরনের বিনিয়োগের বিশাল ডোজ প্রাপক হতে চলেছে। তবে শুধুমাত্র জাপানি তহবিল ও প্রযুক্তিগত ইনপুট ইনজেকশনের জন্য কোনো কঠিন-দ্রুত নিয়ম নেই। অন্যান্য দেশ যেমন দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন এই ধরনের উদ্যোগে অংশ নিয়েছে; তেমনি বাংলাদেশেও অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মসূচীতে তাদের সহযোগিতা এগিয়ে নিতে তাদের আগ্রহ দেখিয়েছে।
ভারত ও চীনের মধ্যে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তর-পূর্ব ভারতে চীনা বিনিয়োগের জন্য খুব কমই উপযুক্ত বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু কোরিয়া ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক সেভেন সিস্টারের অনুরূপ সহযোগিতার অগ্রগতির জন্য যথেষ্ট সহায়ক। এছাড়াও চীন-ভারতীয় সম্পর্ক এতোটা অনুকূল না থাকা সত্ত্বেও, কিছু চীনা স্মার্টফোন কোম্পানি ভারতে সহযোগিতামূলক উদ্যোগের সৌজন্যে ভালো ব্যবসা করছে। অর্থনৈতিক স্বার্থ মাঝে মাঝে দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ককে তিক্ত করতে পারে। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের নেতারা দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থাকে (সার্ক) এগিয়ে নেওয়ার ধারণা ত্যাগ করেছে বলে মনে হচ্ছে। ভারতীয় অর্থনীতির সম্ভাবনা উজ্জ্বল দেখায়, এখন ফোকাস উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা ও উন্নয়নের দিকে পরিচালিত হয়েছে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা সেই দেশগুলোকে হিসাব-নিকাশের বাইরে রেখেছে। ইদানীং, মালদ্বীপও তার রাজনৈতিক সারিবদ্ধতা পরিবর্তন করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার একটি খণ্ডিত আঞ্চলিক রাজনৈতিক শাসনে, নিরপেক্ষ বিনিয়োগকারীরা উপ-অঞ্চলের সন্ধান করতে পারে যেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ নিরাপদ বলে মনে হয়।
হরষৎধঃধহযধষফবৎ২০০০@ুধযড়ড়.পড়স অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : দি ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস