একজন সত্যিকারের শিক্ষক কতোজন শিক্ষার্থীর জীবন বদলে দিতে পারে, আমাদের কি ধারণা আছে?
ড. কামরুল হাসান মামুন
আমার কন্যা আমেরিকায় পড়ছে। আবাসিক হোস্টেলে থাকছে। সে হোস্টেলের প্রতি ফ্লোরের একপাশে ছাত্ররা আরেক পাশে ছাত্রীরা থাকছে। আমার কন্যা অনেক রাত পর্যন্ত লাইব্রেরীতে পড়ে। রুমে আসে শুধু ঘুমাতে। ল্যাবে কাজ করে যখন তখন শুধু পুরুষ শিক্ষক থাকতে অথবা শুধু শুধু ছেলে শিক্ষার্থী থাকতে পারে অথবা উভয়ই থাকে। তার শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন কনফারেন্স বা বিভিন্ন বিশ্¦বিদ্যালয় বা রিসার্চ ল্যাবে নিয়ে গিয়েছে এবং সেখানে হোটেলে থাকতে হয়েছে। এ গল্প শুধু আমার কন্যার ক্ষেত্রেই না। দেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে যাচ্ছে তাদের সবার গল্প। অনেকেই ক্যাম্পাসের বাইরে আলাদা বাসা ভাড়া করে প্রতিটা ছেলে-মেয়ে আলাদা রুমে মিলেমিশে ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে থাকে। আমরা বিগব্যাং সিরিজ কিংবা ফ্রেন্ডস সিরিজেও এমন দেখি। কত আনন্দের সঙ্গে ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে থাকে। সবার আড্ডা দেওয়ার জন্য কমন স্পেস আছে। সেখানে একসঙ্গে হয়ে জম্পেশ আড্ডা দেয়। কোনো মারামারি নেই। কোনো রাজনীতি নেই। কেবলই লেখাপড়া অথবা নানা সামাজিক ইস্যু নিয়ে আড্ডা। এই যে হাজার হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ে লাখ লাখ ছেলে-মেয়ে মিলেমিশে থাকছে কোনো দিনতো মারামারি হয়েছে শুনিনি। কোনো দিনতো গেস্ট রুমে নিয়ে টর্চারের কথা শুনিনি। আমাকে তো আমার কন্যাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় না। বাংলাদেশের হাজার হাজার বাবা-মায়ের সন্তান এখন ইউরোপ আমেরিকায় লেখাপড়া করে। তাদের লেখাপড়া করতে পাঠিয়ে সবাই আমরা নিশ্চিন্তে থাকি।
এ দেশের ক্ষমতাবানদের সন্তানদেরও সে নিরাপদ স্থানে লেখাপড়া করায়। আর দেশের গরিব পিতামাতার সন্তানদের রাজনীতির নামে মাস্তানি, হেডমগিরি, ছিনতাই ইত্যাদি নানা অপকর্ম শেখায়। প্রকাশ্যে এক ক্ষমতা প্রত্যাশী দল আরেক ক্ষমতা প্রত্যাশী দলকে বলে ‘তোমাদের শায়েস্তা করার জন্য আমার ছাত্রই যথেষ্ট। পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশের একজন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতা এমন বলতে পারেন? কেউ যদি বলেন তাহলে জনগণই তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এইদিনই শেষ করে দিত। বাংলাদেশের মাদ্রাসা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য মৃত্যুকূপ। সে মৃত্যু হতে পারে শারীরিক মৃত্যু বা মেধার মৃত্যু যার দায় ভার শিক্ষকদের উপর বর্তায়। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আমাদের ক্যাম্পাসে যা ঘটে তা কোনো সভ্য দেশে ঘটা অকল্পনীয়। বুলয়িং, ইভ-টিজিং, গেস্ট রুম টর্চার, ঘুমানোর বিছানা না থাকা, পড়ার টেবিল না থাকা, ভালো খাবার না থাকা। এরপরেও কয়জন শিক্ষককে দেখেছেন এর প্রতিবাদ করতে? কয়জন শিক্ষককে দেখেছেন শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি জানাতে? কয়জন শিক্ষক নিয়মিত নিজে লেখাপড়া করেন এবং ক্লাসে নিয়মিত পড়ান? কয়জন শিক্ষক নীতি-নৈতিকতা ও চরিত্রের দিক থেকে সত্যিকারের শিক্ষক? বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সত্যিকারের শিক্ষক পাবো কীভাবে? ১০০ বছর আগে শিক্ষক নিয়োগের যে প্রক্রিয়া ছিল আজও সে প্রক্রিয়া চালু আছে। ইনফ্যাক্ট,পুরোপুরি সে প্রক্রিয়া না। বরং সে ১০০ বছর আগে যে ভালো নিয়মগুলো ছিল যেমন অধ্যাপক হিসেবে প্রমোশনের সময় সকল প্রার্থীর সকল কাগজপত্র একজন বিদেশি বিখ্যাত স্কলারের কাছে পাঠানো হতো। সেটা এখন আর নেই।
তখন অরাজনৈতিক এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিখ্যাত কাউকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতো। সে সময় উপাচার্যের অনেক ক্ষমতা ছিল। সে ক্ষমতা তারা ধারণও করতে পারতো এবং তা যথাযথ ডিসচার্জও করতে পারতো। যেমন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আশুতোষ মুখার্জী। তিনি ছিলেন স্বৈরাচারীর মতো। যখন যাকে যোগ্য মনে করতেন তাকেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতেন। কিন্তু কখনোই ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি। প্রতিষ্ঠানের ভালোকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন। এখন আমরা আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে মানের শিক্ষকদের ভিসির দায়িত্ব দিই তাদের অনেকেরই শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতাই নাই ষবঃ ধষড়হব ভিসি। ফলে ভিসিদের উপর সকল ক্ষমতা প্রদান প্রচণ্ড রিস্কি। যার প্রমাণ আজকের বিশ্ববিদ্যালয়। আমিতো চারপাশে শিক্ষক দেখি না। অধিকাংশই দলান্ধ। অনেক পুরুষ শিক্ষকের কাছে ছাত্রী মানে একটি সেক্স অর্গান। তাদের উপর নম্বর দেওয়ার ক্ষমতা আছে। সে ক্ষমতা ব্যবহার করে তারা যৌন নির্যাতন করে। এ পর্যন্ত যতগুলো যৌন নির্যাতন রিপোর্টেড হয়েছে তার অনেকগুন বেশি রিপোর্টেড হয়নি। অনেক ছাত্রী রিপোর্ট করতে পর্যন্ত ভয় পায়।
আসলে আমাদের শিক্ষক প্রক্রিয়াটাই পচা গলা। কেবল মাত্র একটি মৌখিক পরীক্ষা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ হয়। ১৫/২০ মিনিটের একটা ইন্টারভিউ-ই শিক্ষক নিয়োগের একমাত্র প্রক্রিয়া হতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশে পারে বলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য অযোগ্য, দলান্ধ শিক্ষক শিক্ষকতা পেশায় ঢুকে পড়েছে। বিশ্বে শিক্ষক নিয়োগের নানা স্তর থাকে যার প্রতিটি স্তরেই ফিল্টারিং হয়। একাধিক স্তরের কোনো একটিতে বিভাগের সকল শিক্ষক এমনকি ছাত্রদের মতামতও নেওয়া হয়। প্রার্থীদের কাছ থেকে টিচিং ও রিসার্চ স্টেটমেন্ট চাওয়া হয়, ৩ জন গুণী স্কলারের কাছ থেকে রেকমেন্ডেশন লেটার চাওয়া হয়।
প্রার্থীদের দিয়ে সেমিনার দেওয়ানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নিয়োগ একটা বিরাট ব্যাপার। আমরা এটাকে খেও বানিয়ে ফেলেছি। শিক্ষক নিয়োগ এখন মাফিয়া তন্ত্রের হাতে বন্দি। প্রতিটা বিভাগে মাফিয়াদের প্রতিনিধি আছে। ছাত্ররাও জানে সে প্রতিনিধিকে। তারা তার সঙ্গেই থিসিস করতে চায়, তার সঙ্গেই সম্পর্ক উষ্ণ রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে, সে যাকে অপছন্দ করে ছাত্ররাও সে শিক্ষকের ধারেকাছেও যায় না। তাহলে আমরা কি আসলে বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়েছি? সমাজের কোনো পক্ষ কি এসব অনিয়ম নিয়ে কথা বলে? ছাত্ররা কি প্রতিবাদ করে? একজন সত্যিকারের শিক্ষক কতজন শিক্ষার্থীর জীবন বদলে দিতে পারে আমাদের কি ধারণা আছে? তবে একজন মিথ্যাকার শিক্ষক অনেক ছাত্রের জীবন ধ্বংস করতে পারে, সে উদাহরণ বাংলাদেশে অনেক আছে। তারপরেও কেউ প্রতিবাদ করে না। বলে না যে এভাবে চলতে পারে না, এভাবে চলতে দেবো না।
লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়